Monday, February 1, 2016

যখন আমি পুলিশ ছিলাম (তিন) / সন্তোষ বড়ুয়া

আবার যোগদান
নিশ্চয় ফিরে গিয়েছিলাম আবার। না হয় পুলিশ হলাম কীভাবে? পালিয়ে আসার / দিনের মাথায় লিখিত নোটিশ এল গ্রামের বাড়ির ঠিকানায়। আর সেই নোটিশ নিয়ে আমাদের এক কাকা( বলাই ) এলেন আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেলুম্বিনীতে তখন আমিও সেখানে ছিলাম। আমার এই বলাই কাকা বোবা, তিনি কথা বলতে পারেন না, তবে
নোটিশ যে আমার সেটা জানেন। তিনি আমাকে দেখেই হৈ চৈ জুড়ে দিলেন , কিন্তু তাঁর কথার কিছুই আমি বুঝলাম না। বাবা পরে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, আমার পালিয়ে আসায় কাকা ক্ষুব্ধ। তিনি বোঝাতে চাচ্ছিলেন যে পুলিশের চাকরি ভালো। আমি যেন চলে যাই। নোটিশ পরে দেখলাম আমাকে জানুয়ারির ৩০ তারিখের আগেই পুনরায় যোগদান করতে বলা হয়েছে, অন্যথায় আমাকে প্রশিক্ষণ থেকে বাদ দিয়ে ওয়েটিং লিস্ট থেকে ক্যাডেট আহ্বান করা হবে। মনের ভেতর ফিরে যাওয়া না যাওয়ার প্রশ্ন নিয়ে কয়েকদিন কাটিয়ে দিলাম চট্টগ্রামে। এর মধ্যে রহমতগঞ্জ জেএমসেন হলের মাঠে কী এক অনুষ্ঠানে দেখা হলো আমার বাংলা বিভাগের শিক্ষক সৌরেন স্যার এবং বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভিভাগের শিক্ষক আমার সিনিয়র লেখক বন্ধু খ্যাতিমান কথা সাহিত্যিক মহিবুল আজিজ স্বপন ভাইয়ের সাথে। তারা দুজন দুরকম পরামর্শ দিলেন। সৌরেন স্যার বললেন ফিরে যেতে, আর স্বপন ভাই বললেন না যেতে। ওরা দুজনই আমার প্রিয় মানুষ, তবে সেদিন আমি সৌরেন স্যারের কথা রেখেছি, স্বপন ভাইয়ের নয়। আমি আমার পুলিশি জীবনে অনেক আনন্দ পেয়েছি, অনেক প্রকার লোকজনের সাথে মেলামেশা করার সুযোগ পেয়েছি যা পুলিশী জীবন ছাড়া সম্ভব ছিল না। তারপরও এখনও মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না। কোনো মানুষই জীবনে সব ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, আমিও পারিনি। তাতে কী?

পুনরায় রওনা হলাম সারদার পথে। এবার সাথী হলেন রাজীব দা, যিনি আমাকে পুলিশে যাবার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। এবার আর ঢাকা দিয়ে গেলাম না, রওনা হলাম চট্টগ্রাম থেকে বাহাদুরাবাদ মেইলে। এই ট্রেনে ময়মনসিংহ হয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাটে পৌঁছাব, তারপর রেল ফেরি পার হয়ে ওপাড়ে সিরাজগঞ্জ হয়ে রাজশাহী পৌঁছাব। ঠিক রাজশাহী যাব না, নামব হলদিগাছি ষ্টেশনে। সেখান থেকে আবার রিক্সায় বা টমটমে পুলিশ একাডেমি সারদা। এই স্টেশনটি হলো বানেশ্বর আর পুলিশ একাডেমীর মাঝামাঝি স্থানে। এই ট্রেনে যাবার অন্যতম কারণ হলো দেখি না- ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশ। মনে পড়ে সেদিন হলদিগাছি ষ্টেশনে নামা হয়নি আমাদের।  কি এক কারণে ঈশ্বরদী জংশনে ট্রেনের বিলম্ব হওয়ায় আমরা নেমে পড়েছিলাম সেখানে। তারপর ঈশ্বরদী থেকে বাসে গিয়েছিলাম সেই বানেশ্বর বানেশ্বর থেকে আবার টমটমে সারদা পুলিশ একাডেমী।

যেদিন রওনা হলাম তার পরদিন বিকালে পৌঁছে গেলাম আবার পুলিশ একাডেমি। ভয়ে ভয়ে যোগ দিলাম সন্ধ্যার রোল কল প্যারেডে। হাবিলদার মেজর সরোয়ার ওস্তাদ আমাকে ফল আউট করিয়ে কিছু কথা বললেন। বললেনতোমরা দেখ এই ছেলে ধনী লোকের সন্তান, তাঁর বাবা দানবীর, একটি হাই স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, সে আবার ফিরে এসেছে। ভালো করেছে সে বকাঝকা কিছুই করলেন না। বললেন ফিরে গিয়েছি ভালো হয়েছে, আর যেন পালিয়ে না  যাই। কিন্তু আমার আমার পরিবার সম্পর্কে এত কথা বলল কে তাঁকে ? পরে জেনেছি সারদায় আমাদের এলাকার একজন এসআই চাকরি করতেন. নাম প্রিয়দর্শী বড়ুয়াতিনিই আমি পালিয়ে আসার পর এসব কথা মেজর হাবিলদারকে বলেছিলেন। কিন্তু আমি তখনও তাঁকে চিনি না, যিনি আমার বাবার পরিচয় দিয়েছেন আমাদের হাবিলদার মেজরকে। 

আমি যেহেতু আমার সব মালামাল ফেলেই পালিয়ে গিয়েছিলাম সে কারণে ফিরে আসার সময় আনতে হয়নি কিছুই। যেখানে আমার বিছানা ছিল সেখানেই পেয়েছি সব কিছু। পরদিন রাজীব দা চলে আসার সময় বলেছিলেন চাকরিতে আসার জন্য তিনিই উদ্বুদ্ধ করেছেন, তাই তিনিই আবার পৌঁছে দিয়ে গেলেন। প্রথমবারই যদি তিনি দিয়ে যেতেন তাহলে হয়তো আমি পালিয়ে যেতাম না। এই রাজীব দা আত্মীয়সুত্রে আমার বৌদির বড় ভাই, কিন্তু আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন।

আবার মনযোগ দিলাম মাঠের প্রশিক্ষণে এবং ক্লাসে। ইন্সপেক্টর হারুন স্যার ক্লাসে বললেন এই ছেলে পালিয়ে গিয়ে ফিরে এসেছে, সে ভালো অফিসার হবে। পরবর্তীকালে এই হারুন স্যারের খুবই স্নেহ পেয়েছি প্রশিক্ষণ চলাকালে। একদিন আইনের ক্লাসে তিনি আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, আমারা কেউ কোনদিন মদ পান করেছি কিনা? সেদিন আমি ছাড়া কেউ হাত তুলে জানায়নি, যে তারা মদ পান করেছে। স্যার বললেন- এই ছেলের সৎসাহস আছে, সে স্বীকার করেছে কিন্তু এই ক্লাসের অনেকেই যে পান করেছে সেটাও ঠিক, তবে সত্য বলার সাহস আর কারও নেই।

পালিয়ে যাবার শাস্তি
পুনরায় যোগদান করার কয়েকদিন পরই ক্লাসে নোটিশ এল আমার নামে। আমি বিনা অনুমুতিতে একাডেমি থেকে গরহাজির থাকায় ১৪দিন এক ঘণ্টা করে অতিরিক্ত ড্রিল করতে হবে। নিয়মিত প্যারেডের সময়ের এক ঘণ্টা আগে আমি মাঠে যাব, এক ঘণ্টা অতিরিক্ত ড্রিল করে তারপর নিয়মিত প্যারেডে মিলব। মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল আমাদের ক্যাডেট ব্যারাকের নিচ তলায় থাকতেন ইন্সপেক্টর প্রমীর চাকমা। তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে মন খারাপ
না করার উপদেশ দিলেন। বললেন, এটা কোনো বিষয় নয়, দেখতে দেখতেই কেটে যাবে ১৪ দিন। তাছাড়া অতিরিক্ত ড্রিল কোনো পানিশমেন্ট নয়, এটা সার্ভিস বুকে রেকর্ড করা হবে না। এক সময় আমার সেই ১৪ দিন কেটে গেল। আমার বন্ধুরা যখন আইনের ক্লাস থেকে ফিরে দুপুরের খাওয়া সেরে রেস্ট করত আমি তখন ছুটতাম মাঠে। হিংসুটে(!) বন্ধুরা বলত- যাও যাও, বাড়ি গিয়ে কিছুদিন তো আরাম করে এসেছ, এবার সেটা পুষিয়ে দাও। কি আর করা আরামের হিসাব আমি পুষিয়ে দিয়েছিলাম কড়ায় গণ্ডায়। পুলিশ একাডেমীতে অপরাধের ক্ষমা বলে কোনো শব্দ নাই। ক্ষমা থাকলে এত প্রশিক্ষণার্থী নিয়ন্ত্রণে রাখাও কঠিন হত বৈকি।

এসে গেল শহীদ দিবস
এর মধ্যে এসে গেল ২১, ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস। মহা সমারোহে পালন করা হবে শহিদ দিবস। একদিন সন্ধ্যার রোল কল প্যারেডে জানান হলো- যারা গান-বাজনা জানে, কবিতা পড়তে বা আবৃত্তি করতে পারে তারা নাম জমা দেবে মনিটরের কাছে। আমি তো ভীষণ খুশি। তবলা বাজানো, এবং স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি দুই পর্বেই নাম জমা দিলাম। সহকারী পুলিশ সুপার ইউসুপ স্যারের পরিচালনায় শুরু হয়ে গেল রিহারসেল। সকালে মাঝে মাঝে প্যারেড মাপ, সন্ধ্যার আনি ক্লাস মাপ হয়ে গেল। আমাদের এই মাপ দেখে অন্যদের পিত্ত জ্বলত। কারণ সারদায় প্রশিক্ষণ থেকে রিলিজ পাওয়া সাংঘাতিক বিষয়। নুরুল আমিন নামে আমার এক বন্ধু বলত-‘ তবলা-ডুগি বাজাইয়া প্যারেড মাপ? ভাল বুদ্ধি পাইছ।আমাদের ব্যাচে এই নুরুল আমিন সবচেয়ে নিরহ পুলিশ অফিসার। এখনো নিরহই আছে বলে জানি।

ছয়নং ব্যারাকের গল্প আগেই করেছি। এই ছয়নং ব্যারাকে শুরু হয়ে গেল সান্ধ্যকালীন রিহারসেল। তবলায় আমার সাথে যোগ দিল এক ট্রাফিক সার্জেন্ট তৈয়বও। মজায় মজায় কাটতে থাকল দিন। সকালে প্যারেডে যাই না, বিকালে যাই না ক্লাসে। আমাদের সাথে যোগ দিল গানে মিজানুর রহমান কচি, বিপুল বড়ুয়া, মনিটর ছিদ্দিক। মাকফুবার আবৃত্তি করত ভাল। সে পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন আবৃত্তি করত চমৎকার। এখন সে টি ভি তে ডিটেকটিভ ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করছে দেখছি। সবচেমাজার বিষয় ছিল ক্যাডেটদের এক বিশাল টীম যোগ দেয় কোরাস দলে। কোনদিন গান গায়নি এমন কেউ কেউ যোগ দিয়েছিল শুনেছি। আর যোগ দেওয়ার কারন হল কয়েকদিন পি টি, প্যারেড থেকে অব্যাহতি পাওয়া।
স্বাধীনতা দিবস 

একুশের অনুষ্ঠান শেষ হবার কয়েকদিন পরই শুরু হয়ে গেল স্বাধীনতা দিবসের রিহারসেল। এবার এসে যোগ দিলেন প্রবি এএসপিরা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বেনজীর আহম্মদ ( বর্তমানে র‌্যাব এর ডিজি ) এবং মিলি বিশ্বাস ( এখন ডিআইজি ) দুজনই ভাল গাইতেন। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান শেষে শিক্ষানবীশ এএসপি, আউট সাইড ক্যাডেট, হাবিলদার, কনস্টেবল সবাইকে নিয়ে গঠিত হয়ে গেল পুলিশ সাংস্কৃতিক টিম। এবার যেন একটু একটু মজা পেতে লাগলাম পুলিশ একাডেমিতে। সহ্য হয়ে আসছে মাঠের ট্রেনিংও।

চেমনি মেমরিয়েল অডিটরিয়ামের গল্প 
আমরা একাডেমীতে যে হলটাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতাম সেই অডিটরিয়ামের নাম ছিলচেমনি মেমরিয়াল হল কে এই চেমনি? ইতিহাস থেকে জানা যায়- চেমনি সাহেব ছিলেন ব্রিটিশ সেনা বাহিনীর মেজর। পুনর্গঠিত বেঙ্গল পুলিশ কলেজের প্রথম প্রিন্সিপ্যাল। তিনি কর্মরত ছিলেন ভারতের গাজিপুরে। সে সময় মেজর চেমনি সাহেব একবার গাজীপুর থেকে কলিকাতা স্টিমারে ভ্রমণ করার সময় যাত্রা বিরতি করেন সারদার চারঘাট স্টিমার স্টেশনে। সেখানে নদীর পারে নেমে দেখেন এক বিশাল মাঠ, আর দুটি সুন্দর পুরনো বাড়ি। সেটা ছিল মুলত মেদিনীপুরের জমিদারের কাচারি। এখানে চলত খাজনা আদায়ের কাজ। দেখে জায়গাটা পছন্দ হয়ে গেল চেমনি সাহেবের। ভাবলেন এরকম একটা মনোরম স্থানই তো তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন পুলিশ ট্রেনিং কলেজের জন্য। সেবার ফিরে গিয়েই তিনি এই স্থানের উল্লেখ করে ভারত সরকার বরাবরে প্রস্তাব পাঠান এবং প্রস্তাব অনুমোদনও পেয়ে যায়। মোট ১৪২.৬৬ একর জমিসহ মেদিনীপুরের জমিদারের এই কাচারি ২৫ হাজার টাকায় কিনে নেন ভারত সরকার। সেখানেই ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করা হয় অবিভক্ত ভারতের পুলিশ ট্রেনিং কলেজ। যার প্রথম প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন মেজর চেমনি। এই পুলিশ ট্রেনিং কলেজে প্রশিক্ষণ নিত বেঙ্গল আসামের পুলিশের সদস্যরা।


ট্রেনিং করার সময় এরকমও শুনেছি যে- সারদা মাঠের দুই পাশে যে দুটি পুরানো ভবন আছে, সেই ভবন দুটি এক সময় নীলকর সাহেবদের কুঠি বাড়ি ছিল। যার পূর্ব পাশেরটি ব্যবহার হয় এএসপিদের মেস হিসাবে, অপরটি অর্থাৎ পশ্চিম পাশেরটি ব্যাবহার করা হয় প্রিন্সিপালের বাংলো হিসাবে।


লেখক : সনতোষ বড়ুয়া, কবি, ছড়াকার ও গল্পকার। প্রাক্তন পুলিশ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পুলিশ।  

No comments:

Post a Comment