Monday, February 1, 2016

কোরবানির মাংস / এম এল গনি

এডমন্টন শহরে আমার বিশিষ্ট বন্ধুদের একজন মাইকেল | নামটা মাইকেল হলেও আসলে আমাদের অনেকের মতো বাংলাদেশী মুসলমান সে | কোরবানির ঈদের সপ্তাহ দু'য়েক আগে ফোন দিয়ে জানতে চাইলো এবারের কোরবানিতে আমাদের পরিকল্পনা বিষয়ে | তার মানে, গরু দেবো না খাসি দেবো, আগের সেই পাকিস্থানি হালাল মাংসের দোকানের মাধ্যমে কোরবানী করবো, না অন্য কারো
মাধ্যমে, .. এসব আর কি |

তার প্রশ্নের উত্তরে বললাম, কেনো দোস্ত, পাকিস্তানি দোকানটা তো ভালই সার্ভিস দেয়, কোয়ালিটি মাংস, ওজনে হেরফের নেই, দামও রিজনেবল, সমস্যা কোথায় ? ওকে দিয়ে করি না কেনো? 

- আরে পলাশ, তুমি তো আসল খবর জানোনা, গেল শুক্রবার জাবের সাহেব নামের এক পাকিস্তানি মাওলানা জুমুয়ার নামাজে বলেছেন, সুন্নি মুসলমানদের উচিত সুন্নি মুসলমানের মাধ্যমেই কোরবানী করা | জাবের সাহেবও সুন্নি মুসলমান; দু'দুবার হজ্ব করেছেন, কথাবার্তায়ও বেশ ভদ্র | মিথ্যে বলার মানুষ মনে হলো না .. | আমাদের পাকিস্থানি হালাল মাংসের দোকানি আব্দুল কিন্তু আহমদিয়া মুসলমান, জানো তো !

তা জানি, কিন্তু, ভালই তো চলছিল সব, তো সুন্নি লোক পাবো কোথায়, কোরবানির সময় যে ঘনিয়ে এলো | তুমি কাউকে চেনো-টেনো নাকি ?

- জাবের সাহেব নিজেই নাকি সুন্নি মুসলমানদের জন্য কোরবানী দেয়ার কাজ শুরু করেছেন গত বছর থেকে | আমি নামাজের পর তাঁর সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছি | বুঝোনা !.., কোরবানী যখন দিতেই হবে, তা যতটুকু পারা যায় ছহি করে দিলেই তো ভালো ..

হাসিমুখে বললাম, তুমি পিএইচডি মানুষ, সবকিছুতে রিসার্চ করে অভ্যেস | তুমি ভুল এনালাইসিস করো কি করে? এগিয়ে যাও বন্ধু |.. মাইকেল তুমি এগিয়ে চলো, পলাশ আছে তোমার সাথে .. রসিকতা করে বললাম | ও আবার রাজনীতির মানুষ তো !

বন্ধুরা, আপনারা যারা দেশে থাকেন তাঁরা খুব ভাগ্যবান | ঘরের উঠোনে নিজের বাসার সামনে পশু জবাই দিয়ে কোরবানির আসল সাধটা ভোগ করার সুযোগ আপনাদের আছে | কিন্তু, কানাডা, আমেরিকা, বা উন্নত দেশগুলোতে বিষয়টা অত সহজ নয় | কিছু সরকার অনুমোদিত স্লটার হাউজ আছে এসব দেশে | সেখানে গিয়েই আপনার নামে পশু কোরবানী করা হবে | সময় ও ঝামেলা এড়াতে, আমরা নিজেরা না যেয়ে সাধারণত কোনো তৃতীয় পক্ষ বা এজেন্টের সহায়তায় এ পবিত্র কাজটা সেরে থাকি | এজেন্ট মাংস রেডি হলে আমাদের ফোন দেন | ফোন পেয়ে আমরা যার যার মাংসের ভাগ বাসায় নিয়ে আসি | এ প্রক্রিয়ায় চার-পাঁচদিন লেগে যায় ..

চারদিন পর জাবের সাহেবের ফোন পেলাম | জানালেন, শুক্রবার বেলা তিনটায় তার বাসার সামনে হাজির হতে | আমরা যে গরুটা কিনলাম তার সাত ভাগের একভাগ আমাদের | এত বেশি গরুর মাংস বছরের আর কোনো সময় কেনা হয় না | আমাদের বাসার সবাই বেশ পুলকিত এ ভেবে যে, শুধু টুকরো করা কিছু বোনলেস মাংস নয়, গরুর বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সবকিছুই খাবার সুযোগ হবে আজ: মগজ, পা, বুকের নরম হাড্ডি, কলিজা, আম, .. কত কি ! 

এ ছাড়া আমার ভেতরে আর একটা বাড়তি আনন্দও কাজ করছিল এ কারণে, এবারের কোরবানীটা আল্লাহ'র রহমতে অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক পারফেক্ট হচ্ছে | আমি সুন্নি মুসলমান, আর আমার কোরবানিটাও হচ্ছে বিদগ্ধজন এক সুন্নি মুসলমানকে দিয়ে | একদিকে এটা ভেবে পরমানন্দ, অন্যদিকে জাবের সাহেবের খোঁজ পেতে এত দেরী হলো কেনো তা ভেবে মনে একটা চাপা বেদনা | আমরা এডমন্টন শহরে এসেছি কি এক-দু'দিনের কথা !

ঘড়ির কাঁটা ধরে যথাসময়ে হাজির হলাম তাঁর ঠিকানায় | সাথে আমার ছ'বছরের আয়মানও আছে | ওদেরও ধর্ম-কর্ম শেখাতে হবে তো ! আরো জনাবিশেক লোকও কোরবানির মাংশ বুঝে নিতে এসেছেন | 

শুরুতেই জাবের সাহেব ছোটখাটো একটা ধর্মীয় বক্তৃতা দিলেন | পবিত্র কোরানের বিভিন্ন আয়াত উদ্ধৃত করলেন জায়গামতো | প্রয়োজনমতো হাদিস শরীফের রেফারেন্সও দিলেন | তুখোড় বক্তা দেখি ! কোরবানী কি কারণে দিতে হয়, মাংশ কিভাবে ভাগ-বাটোয়ারা করতে হয়, ধর্মীয় বিধিমতে কিভাবে পশু জবাই দেয়া হয়েছে, .. সবকিছু বর্ণনা করে দীর্ঘ মোনাজাত করলেন রাব্বুল আলা'মিনের কাছে দু'হাত উপরে তুলে | তারপর, প্লাস্টিক ব্যাগে মোড়া মাংসের ব্যাগটা নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বাসায় ফিরলাম |

আমার স্ত্রীকে নিয়ে ব্যাগ খুলে দেখি, মাংসের আশি শতাংশই পাঁজরের হাঁড় | বাকি অংশে পায়ের উপরের দিকের বিশাল সব হাড্ডি মাখা কিছু মাংস | স্পর্শ করে বুঝলাম, ডিপ ফ্রিজে রাখা আগের কিছু মাংসও মিশিয়ে দেয়া আছে ..| 

মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো | পাকিস্তানি দোকানের আহমদিয়া মুসলমান আব্দুলকে খুব মিস করছিলাম তখন | - এ কাহিনী অবশ্য গেল বছরের |

 এম এল গনি : কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশি কথা সাহিত্যিক, প্রকৌশলী ও গবেষক।


No comments:

Post a Comment