Monday, February 1, 2016

ঠোঁটকাটা / এম এল গনি

ঠোঁটকাটা ==

বাসার সবার মন ভারী হয়ে আছে | দেশে যাবেন শ্বাশুড়িমা বছর খানেকের জন্য | তাঁকে এগিয়ে দিতে এডমন্টন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গেলাম সপরিবারে | বড় দুটো ব্যাগের ট্রলিটা ঠেলছি আমি, আমার স্ত্রীর হাতে ক্যারিঅন বা, হ্যান্ড লাগেজ দুটো, আর আমাদের বারো বছরের কিশোর ছেলেটা নানির হাত ধরে ধীরপায়ে হেটে চলেছে আমাদের সাথে | ছোটখাটো একটা মৌন মিছিল রীতিমত | ডেপারচার বা, বহির্গামী ফ্লাইটের লাউঞ্জ উপরের তলায়, আর এরাইভাল লাউঞ্জ নিচে |

উপরের তলার উনত্রিশ নম্বর গেইট দিয়ে ঢুকেছি আমরা; যেতে হবে গেইট নম্বর আটে, বামদিকে | ঝকঝকে তকতকে এয়ারপোর্টের ভেতরে হাটাহাটি মন্দ লাগছে না | কিছুদুর যেতেই আমাদের সবার চোখ আটকে গেল বিপরীত দিক থেকে হেটে আসা তিরিশ-বত্রিশ
বছরের এক সুঠামদেহী শ্বেতাঙ্গ যুবকের দিকে | যুবকের বুকের উপর গলার দু'পাশে ঝুলছে দুটি পা | বিশ-বাইশ বছরের এক মেয়ে তার কাঁধে চুপচাপ বসে গলা জড়িয়ে আছে দুহাতে | দূর থেকে দেখে বোঝা গেল মেয়েটা হাটাচলায় অক্ষম বা, বিকলাঙ্গ | ধারণা করি, ভাই বা কোন আপনজন চলাফেরায় অপারগ তার অতিপ্রিয় বোনটিকে কোন দুরের গন্তব্যের ফ্লাইটে তুলে দিতে ছুটে এসেছে বিমানবন্দরে | এমনও হতে পারে, এই অসুস্থ মেয়েটি আমার শ্বাশুড়িমা'র সহযাত্রী |

আদরের মেয়ে, নাতি-নাতনি, সবাইকে ফেলে দীর্ঘদিনের জন্য দেশে যাচ্ছেন মা | স্বভাবতই মনে অনেক বেদনা তাঁর | তাই, যতটা পারা যায়, মন চাঙ্গা থাকে এমনসব কথা বলে তাঁর বিদায়্ক্ষনটা আনন্দময় করে তোলার চেষ্টার ত্রুটি নেই আমার | ঘর থেকে বের হবার আগে আমার স্ত্রীকেও কানে কানে বলে দিয়েছি বিমানবন্দরে মা'কে জড়িয়ে ধরে যেন বিদায়ী কান্নাটান্না জুড়ে না দেয় আবার | কারণ, উনি একাকী এমন দীর্ঘ একটা পথ ভ্রমন করবেন; তাই, তাঁকে কান্নাকাটি দিয়ে যাত্রা শুরু করানো মোটেও বুদ্ধির কাজ হবে না| সেরকম কিছু করলে নার্ভাস হয়ে মাঝপথে পাসপোর্ট বা দরকারী কাগজপত্রও হারিয়ে ফেলতে পারেন | অবশ্য আমি চাইলেই তো আর হবে না, তাঁর কপালেও শুভযাত্রা থাকতে হবে তো ! ভাগ্যের উপর কী কারো হাত আছে?

উদ্বিগ্ন চেহারা দেখে বুঝলাম, অচল মেয়েটাকে দেখে মা'র মনটা হঠাতই খারাপ হয়ে গেছে | এমনিতেই সামান্য কারণে তাঁর টেনশন করার অভ্যাস; হাইপারটেনশনের রোগী | নিজের বিষয়েও টেনশন করেন, অন্যের বিষয়েও করেন | কারো দুরাবস্থা দেখলেই তাঁর মনটা বদলে যায়, হোক সে আপন বা পর | আমাদের ভাগ্যটা খারাপই বলতে হয়, না হয় বিকলাঙ্গ বোনকে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এ যুবক মায়ের যাত্রার শুরুতেই এভাবে আমাদের চোখের সামনে এসে হাজির হবে কেন? তাকে দেখার কয়েক মুহূর্ত যেতেই মা মুখ গম্ভীর করে মন্তব্য করলেন, আহ, ফুলের মত সুন্দর একটা কচি মেয়ের এ অবস্থা হলো কী করে? 

কথাটা শুনে আমি মার উদ্দেশ্যে বললাম, কি আর হবে মা, অসুস্থ আর কি ! এদেশে এরকম অনেক আছে | এ ধরনের হ্যান্ডিক্যাপ মানুষেরা সরকার থেকে ভাল অঙ্কের মাসিক ভাতা পায়, জানেন?

উত্তরে মা বললেন, আমাদের বাংলাদেশ গরিব হলেও এত বেশি বিকলাঙ্গ বাচ্চাকাচ্চা দেখা যায় না বাবা | - মা'র এ মন্তব্য শুনে বলতে ইচ্ছে করলো, 'মা, এসব অক্ষম মানুষ রাস্তাঘাটে দেখবেন কেমনে? ওদের দেখতে আপনাকে যেতে হবে চট্টগ্রাম শহরের মাজারগুলোতে | তাহলে দেখতেন, সুরেলা কন্ঠে আল্লাহু আল্লাহু রব তুলে কত বিচিত্র কায়দায় তারা ভিক্ষাবৃত্তি চালিয়ে যাচ্ছে |' যাই হউক, মুরুব্বির মুখের উপর কী আর কথা বলা যায়? আমি বরং তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, উন্নত দেশে বিকলাঙ্গ বাচ্চার সংখ্যা বেশি হবার কারণ কী মনে করেন মা?

ঠিক এ সময়টায় গলা জড়িয়ে কাঁধে বসে থাকা মেয়েটাকে নিয়ে যুবক আমাদের খুব কাছ দিয়ে হেটে গেলো | মেয়েটার দু'পা ঝুলছে যুবকের বুক দু'ভাগ করে, হাতদুটো গলা জড়িয়ে, ডানগালটা যুবকের মাথার তালুর চুলগুলোর উপর লেপ্টে আছে, চোখদুটো প্রায় বন্ধ অবস্থা | অচল হলেও মুখে মেক-আপের কমতি নেই, দু'কানে ঝুলছে বড় আকারের গোলমতো দু'টো সাদা রিং | নজরকাড়া চোখ, চিপচিপে গড়ন, রূপ-যৌবনে ভরাকলসির টইটুম্বরতা; কেবল হাটতে পারে না, সমস্যাটা এখানেই | সবই আছে, আবার কিছুই নেই, এমন অবস্থা দেখে পাষানের বুকেও এ মেয়ের জন্য মায়া জাগবে, আমার শ্বাশুড়ি মা তো অনেক নরম মনের মানুষ; তাঁর কথা বাদই দিলাম | সত্যি বলতে কী, ভগবানের লীলা বোঝা দায় | এমন দৃষ্টান্ত চোখের সামনে হাজির করে তিনি হয়তো বলতে চাইছেন, 'হে সুস্থ-সবল মানুষেরা, তোমাদের মাঝে যারা জ্ঞানী তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো, আমার অসাধ্য বলে কিছু নেই; এমন বুক কাঁপানো সুন্দরী মেয়েকেও আমি কেমন অনড়-অচল করে রাখতে পারি দেখো, তার সব থেকেও কিছু নেই, দেখো আমার ক্ষমতা ..'

আমার প্রশ্নের উত্তরে মা বললেন, সন্তান পেটে আসে আল্লাহর হুকুমে; তাঁর নির্দেশ ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না | সন্তান-সন্ততি হলো মানুষের প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত | মায়ের পেটে যখন বাচ্চা আসে তখন তাকে ধর্মীয় বিধিবিধান কঠোরভাবে মেনে চলতে হয় | তাছাড়া মুরুব্বিদের শিখিয়ে দেয়া অনেক আচারও পালন করতে হয় ..

'আচারগুলো কেমন মা?' তাঁর কাছে জানতে চাইলাম | প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমার স্ত্রী আবার কমকথা বলা গম্ভীর স্বভাবের মেয়ে | মনে প্রশ্ন জাগলেও অনেক সময় জানতে না চেয়ে চুপচাপ বসে থাকে; আমি ওরকম স্বভাবের না | 

মা বললেন, যেমন, অমাবস্যার রাতে চলাফেরায় গর্ভবতী মেয়েদের অনেক সাবধানী হতে হয়; তখন মাছের গলা বা মাথা কাটাকুটা করতে মানা ..

- করলে?

করলে ঠোঁট কাটা বাচ্চা হবে | 

- হুমম! আর?

গর্ভে বাচ্চা থাকা অবস্থায় ভরদুপুরে একাকী বেলতলায় যেতে নেই ..

- গেলে?

বেলতলায় ভরদুপুরে জ্বিন-পরীরা বসে আড্ডা দেই, বিশ্রাম করে | ওদের বাতাস গায়ে লাগলে ...

মন্ত্রমুগ্ধের মতো মা'র কথাগুলো শুনছিলাম | ওসব সত্য মিথ্যা জানিনা, তবে শুনতে বেশ লাগছিল |

মা'র কথা শুনতে শুনতে পাশের চেয়ারে বসে থাকা আমার স্ত্রীর দিকে আড়চোখে তাকাতেই ও মুচকি হেসে চোখ ফিরিয়ে নিল | আমারও অবশ্য মনে মনে হাসি পাচ্ছিল মা'র কথাগুলো শুনে; তাও মুরুব্বির সামনে ভাবগম্ভীর পরিবেশ বজায় রাখলাম যথারীতি | মাথায় এ চিন্তাও কিন্তু আসছে, মা'র মাথাটাতা ঠিক আছে তো? না হয় কানাডার এডমন্টন শহরে উনি ভরদুপুরে বেলগাছ, বা অমাবস্যার রাতে মাছের গলা কাটার মত বিষয় নিয়ে কথা বলবেন কেন? যাক, বাংলাদেশের গ্রামীন চিত্র মাথায় রেখেই হয়তোবা উনি কথাগুলো বলেছেন | জীবনের বেশিরভাগই গ্রামেগঞ্জে কাটিয়েছেন তো ! 

কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়ানো মেয়েটাকে দেখে বারো বছর আগের এক স্মৃতি মনে ভেসে উঠলো আমার | নেদারল্যান্ডের আমস্টার্ডাম শহরে কিছুদিন বসবাস করেছি স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করতে গিয়ে | সে সময় বাচ্চাকাচ্চা বলতে আমাদের সাড়ে তিন বছরের মেয়েটাই | পঁচিশে এপ্রিলের ফ্লাওয়ার প্যারেড দেখতে রাস্তায় বেরিয়েছি আমার স্ত্রী আর শিশুকন্যাকে নিয়ে | প্রতি বছরই এ সময়ে আমস্টার্ডাম শহরে এ প্যারেডটা হয় | মেয়েটা হাটতে জানলেও অত লম্বা সময় ধরে হাটার মত পায়ের ভিত তখনো তার হয়নি | কয়েক মিনিট পরপরই ওকে কাঁধে চড়িয়ে হাটতে হচ্ছিল আমার | 

সহস্র ফুলে মোড়ানো শত শত গাড়ি ধীরে ধীরে ছুটে চলেছে শহরের রাস্তায় | গাড়িতে রাজকন্যার সাজে বসে আছে ফুলে ফুলে সাজানো অসাধারণ সব সুন্দরীরা | নানা রঙের ফুলের বাহারে রঙিন চারদিক | মনমাতানো এ দৃশ্য উপভোগ করছি হেটে হেটে, বা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে | সারাদিন এভাবে হাটতে হাটতে আমার ঘাড়টা ব্যথা হয়ে গিয়েছিল রীতিমত | নিজের মেয়ে বলে কথা; কষ্ট হলেও তাকে কাঁধে নিয়েই ঘুরে বেরিয়েছি টানা কয়েক ঘন্টা | একটা ছোট্ট শিশুকে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেই আমার যা কষ্ট হয়েছিল সেদিন, আজও ভুলিনি | অথচ, এ যুবকটা পরিপূর্ণ বয়সের একটা মেয়েকে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অবলীলায়, এত দীর্ঘ সময় ধরে | লোকটার কষ্ট হচ্ছে না? ভাবতেই অবাক লাগছে | এর শরীরে কি তাহলে অসুরের শক্তি ভর করেছে?

মা'র চেক-ইন হয়ে গেলেও আরো ঘন্টাখানেক বাকি আছে আকাশে উড়তে | লাউঞ্জের ভেতরে এক জায়গায় বসে আছি আমরা চারজন | আমার ডানদিকে আমার স্ত্রী, বামে মা, তারপরই আমাদের কিশোর ছেলেটা নানির ওড়নার আঁচল  ধরে বসা | শারীরিক বৈকল্য আর, অটিজম নিয়ে অনেকটা সেমিনারের আদলে আলোচনা চলছে আমাদের ছোট্ট গ্রুপে | প্রধান বক্তা আমি আর মা, অন্য দু'জন নীরব শ্রোতা | একফাঁকে আমার ছেলে হঠাত মন্তব্য করে বসলো, আই ডোন্ট থিঙ্ক দ্যা গার্ল ইজ সিক, দে আর জাস্ট হেভিং ফান (আমার মনে হয় না মেয়েটা অসুস্থ; ওরা স্রেফ মজা করছে) | এ ছেলে বাংলা কথা বুঝলেও সহজে মুখ ফুটে বলতে চায় না; তাই, ইংরেজিতেই বললো | এটুকুন বাচ্চার মুখে এরকম পাকা কথা শুনে ওর নানু কপাল কুঁচকে তার দিকে এক পলক তাকালেন; মাইন্ড করেছেন মনে হলো | বাংলাদেশে হলে আমি হয়তো এই ইঁচড়েপাকা ছেলেটাকে বেশ একটা বকুনি দিয়ে দিতাম এ পরিস্থিতিতে | বলুন তো, একটা পুচকি ছেলের মুরুব্বির ঠোঁটে ঠোঁটে কথা বলা সহ্য করি কি করে? কানাডায় বলে সে আজ বেঁচে গেল | এখানে বকাবকি করলে মানুষ আবার বলবে চাইল্ড এবিউজ হচ্ছে; যত্তোসব ..

আমাদের ডানদিকে খানিক দুরে টিম হর্টন'এর দিকে চোখ গেল মিনিট বিশেক পর | ওদিক থেকে যুবকটা মেয়েটাকে বয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে হেটে আমাদের এদিকে আসছে | তবে, মেয়েটা এবার কাঁধে নয়, লোকটার বুকের দিকে বাদুর ঝোলা ঝুলছে | মাঝে মাঝে ঠোঁটে ঠোঁট রাখছে যুবকের; চোখেমুখে টাইফুনের উন্মাদনা ! বুঝতে বাকি রইলো না, ওদের দু'জনার সম্পর্কটা আসলে অন্যপর্যায়ের, মানে এখানে একটা 'ইয়ে'র ব্যাপার আছে | মাখামাখির উষ্ণতা দেখে মনে খটকা লাগছে; মেয়েটা কী আসলেই বিকলাঙ্গ?

লোকটা যতই আমাদের কাছে আসছে ততই মনে হচ্ছে আমাদের কিশোর ছেলের কথাই ঠিক | আরো কাছাকাছি হতে একসময় দেখলাম মেয়েটা লোকটার বুক থেকে নেমে গিয়ে সুস্থ সবল মানুষের মতোই ডানহাতে যুবকের কোমর জড়িয়ে এদেশী কায়দায় বুক নাচিয়ে হেটে চলেছে | কিছু পরেই আমাদের কাছাকাছি একটা লম্বা চেয়ারে ঘনিষ্ট হয়ে পাশাপাশি বসে আবার ঠোঁটে ঠোঁট মেলালো দু'জন | ডীপ-ভি ড্রেসে টগবগে যৌবনের এ যুবতীতে পেশল যুবকের বাহুতে লাগছেও দারুন | এদিকে আমরা স্বামী-স্ত্রীর মা'র উপস্থিতিতে এমন "বিশ্রী" অবস্থা দেখে লজ্বায় মরার অবস্থা | ভয় হচ্ছে ভেবে, এসব দৃশ্য দেখে মা আবার এদেশে আসবেন তো !..

বিরক্তিভরা চোখে ওই যুগলের দিকে একপলক তাকিয়ে বিড়বিড় করে মা বলে উঠলেন, 'নাউজুবিল্লাহ' | পরক্ষনেই আমাদের পুত্রধনও ওর নানুকে উদ্দেশ্য করে বলে ফেললো, 'আই টোল্ড ইউ নানু' | দেখুন তো, কেমন ঠোঁটকাটা এদেশের বাচ্চাগুলো !

No comments:

Post a Comment