Monday, February 1, 2016

ভুলোমন / এম এল গনি

ভুলোমন ==


অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া ছেলে সাইদ'কে নিয়ে বাসার কাছের এক দোকানে সপ্তাহের বাজার সারতে গেলাম | মাছ-মাংস, চাল-ডাল, চিনি-লবন, কত কি | প্রথমেই গেলাম মাছ-মাংসের দোকানে | দোকানের ভেতরে পা রাখতেই চোখ গেলো কিছু সামনে ডানদিকের কোনায় | ওখানে ফ্রিজে সাজানো মাছ-মাংস, দেশী তরিতরকারিসহ নানা আইটেম | পেছন থেকে শরীরের আকার আকৃতি দেখে বুঝলাম, ওই
কর্নারে শরিফ ভাই আর ভাবি কেনাকাটায় ব্যস্ত | তাঁরা আমাদের দেখতে পাননি নিশ্চিত হয়ে যতদ্রুত পারি, দরজাটা বন্ধ করে উল্টো পথে, মানে, পার্কিং লটে রাখা গাড়ি অভিমুখে হাটতে শুরু করলাম | কেনো জানেন বন্ধুরা? এ লেখার শেষ অধ্যায়ে বলছি সে কাহিনী |

ভেবেছিলাম আমার এ অস্বাভাবিক আচরণে সাইদ অবাক হয়ে জানতে চাইবে, 'আব্বু, দোকানের দরজা থেকে এভাবে ফিরে এলে কোনো; মাংস না কিনলে আমরা ভাত খাবো কি দিয়ে?' - কিন্তু না, ছেলেটা তেমন কিছু বললো না | অবাকই হলাম ওর নিরবতায় |

পরিকল্পনা ছিল এ দোকান থেকে মাছ-মাংস কিনে তারপর খানিক দুরের আরেক দোকান থেকে তেল, চাল, ডাল, ..কিনবো | কিন্তু, শরিফ দম্পতিকে দেখেই সিদ্ধান্ত বদলাতে হলো | ঠিক করলাম, আগে বরং চাল, ডাল, এসবের কেনাকাটা সেরে ফেলি | তারপর এ দোকানে ফিরতে ঘন্টা খানেক লেগে যাবে | ততক্ষণে শরিফ ভাইরা চলে যাবেন | মোটামুটি এমনই চিন্তা ..

গাড়ি চালাতে চালাতে সাইদকে প্রশ্ন করলাম, বাবা, ওই দোকান থেকে ফিরে এলাম কেন জানতে চাইলে না যে ?

বয়সে তরুণ হলেও বেশ ভদ্র স্বভাবের এ ছেলেটা | সরাসরি দোষ ধরিয়ে দিয়ে কারো মনে আঘাত দিতে চায় না | মুচকি হেসে নিচের দিকে চোখ রেখে বলল, এটা কি নতুন কিছু আব্বু?

ওর জবাব শুনে আমার আগ্রহ আরো বেড়ে গেলো | বললাম, তুমি কি বলতে চাইছ আরেকটু বুঝিয়ে বলবে?

- ওই যে, কালকে কি হয়েছে তোমার মনে নেই?

কাল আবার কি হলো?

- ওই যে, ১০৯ স্ট্রিট .. বলেই ও হি হি করে হেসে উঠলো | গলায় এখনো পুরুষালি ধাঁচটা আসেনি; এখনো মেয়েকন্ঠ |

কালকের ঘটনাটা মনে করে আমিও মনে মনে হাসলাম | বুঝলাম, ছেলেকে যতটা নির্লিপ্ত, নিরস বা উদাস ভেবেছিলাম, আসলে তেমন নয় | আপনার আমার মতই রক্তমাংসে ঠাসা স্বাভাবিক এক মানুষ সে |

১০৯ স্ট্রিটের ঘটনাটা এরকম | সাইদকে নিয়ে আমাদের এখানকার আলবার্টা ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত একটা সায়েন্স ফেয়ারে গিয়েছিলাম গত সন্ধ্যায় | গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরছিলাম | বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেটি ধরে পূর্বদিকে আসছিলাম আমরা | কিছুদুর এভাবে গাড়ি চালিয়ে এক সময় ১০৯ স্ট্রিটে বাম দিকে টার্ন নিতে হয় | তা না করে ভুলে আমি ডানদিকে টার্ন নিয়ে ফেলেছি | ভুলটা তাত্ক্ষনিক বুঝে ফেললে অনেক ঝামেলা এড়ানো যেতো; কিন্তু, তা বুঝেছি অনেক পরে |

ভুলপথে আরো প্রায় বিশ মিনিট গাড়ি চালিয়ে এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে ছেলেকে বললাম, বাবা, বসে আছ কেন? দরজা খুলে নেমে পড় |

ছেলে গাড়ি থেকে নামে না; বসেই আছে | আর, অবাক করা চোখে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে |

বললাম, কি বাবা, নামছ না কেন?

(ওর ফার্স্ট লেঙ্গুয়েজ) ইংরেজিতেই বলল, আর ইউ সিরিয়াস ডেড?

ছেলের অস্বাভাবিক প্রশ্নে অবাক না হয়ে পারলাম না | কিছুটা রাগের স্বরে আমিও ইংরেজিতে উত্তর দিলাম, অফ কোর্স !

তারপর এদিক ওদিক ফিরে তাকাতেই আমার সম্বিত ফিরে এলো | বুঝলাম, আমরা আসলে মাস ছয়েক আগে বেচে দেয়া আমাদের পুরনো বাড়িটায় চলে এসেছি | এতবড় ভুল করলাম কি করে? যতদোষ এই ১০৯ স্ট্রিটের | ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার সময় একদিকে টার্ন নিলে আমাদের বর্তমান বাড়ি, আর বিপরীত দিকে টার্ন নিলে পুরনো বাড়িটা; দোষটা কি তাহলে আমার?

বন্ধুরা, আপনারা আমার আপনজন; তাই, স্বীকার করতে লজ্বা কিসের? আসলে, অসম্ভব রকমের ভুলোমনা মানুষ আপনাদের এ লেখক | এ রকম ভুলভাল আমার হরহামেশাই হয় | বউ-বাচ্চাদের আমার এ দুর্বলতা বেশ জানা | ভুলোমন বলে আমার কোনো আক্ষেপও আবার নেই | কারণ, এ সমস্যা আমার একার নয় | পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী, লেখক, আছেন যাঁরা আমার একই দোষে দুষ্ট | সে তুলনায় আমিতো নগন্য | আপনাদের অনেকের প্রিয় এক লেখকের কথা মনে পরছে এ প্রসঙ্গে | বেশ মজার এক ব্যক্তিগত স্মৃতি আছে তাঁর সাথে আমার | শুনুন সে কাহিনী এবার |

শাকুর মজিদ | নামী লেখক, ফটোগ্রাফার; 'মহাজনের নাও' গীতি নাট্যের স্রষ্টা | দু'ডজনের কাছাকাছি বই লিখেছে এযাবত | আমার প্রিয় লেখকদের অন্যতম | - শাকুর বুয়েটে আমার একবছরের জুনিয়র | স্থাপত্যের ছাত্র | ওর এক ক্লাসমেট ছিল আমার রুমমেট | জামিল | মাঝে মাঝে জামিলের সাথে রাতে প্রজেক্টের কাজ করতে যেয়ে আমাদের রুমেই ঘুমিয়ে পড়ত | সেরকম ব্যাপারই ঘটেছে একদিন |

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার দাঁত ব্রাশটা খুঁজে পাই না | বুকশেলফের পেছনে, খাটের নিচে, .. কোথাও নেই | মনটা খারাপ হয়ে গেল | কিছু পরে দেখি ঘুমঘুম চোখে শাকুর মজিদ বাথরুম সেরে আমাদের রুমে ফিরেছে | ডানহাতে আমার ক্ষনিকের জন্য হারিয়ে যাওয়া প্রিয় দাঁত ব্রাশ | .. ছাত্রজীবন বলে কথা; দু'টাকারও অনেক মূল্য তখন | ঠিক মনে নেই, ধুয়ে মুছে ব্রাশটা আবার ব্যবহার করেছিলাম, না ফেলে দিয়েছি | এতকাল পর ঘটনাটা শাকুরের মনে আছে কি না কি জানি | (কাছে থাকলে একটু আওয়াজ দিও শাকুর |)

শরিফ দম্পতির কাহিনী বলি এবার | তাঁরা বাংলাদেশ থেকে কানাডায় এসেছেন বছর পাঁচেক হলো | শরিফ ভাই দেশে সরকারী কলেজে ভূগোল পড়াতেন; আর, ভাবি ছিলেন হাউজ ওয়াইফ | ভাবিদের বাড়িতেই থাকতেন | তার মানে, বাসা ভাড়ার টাকা পুরোটাই জমে যায় | দু'বাচ্চা নিয়ে সুখেই চলছিল তাঁদের সংসার | কার যেন বুদ্ধি ধরে হোটেল ম্যানেজমেন্টের কোর্স করে শ্বশুর সাহেবের অনেক টাকা-পয়সার শ্রাদ্ধ করে কানাডায় ইমিগ্রেশন নিয়ে আসেন | হয়তো মনে করেছিলেন, কানাডা-আমেরিকার বাতাসে ডলার উড়ে, চটের বস্তায় কিছু ভরে নিয়ে বাকি জীবনটা আয়েসেই কাটিয়ে দেবেন; এই আর কি !

ভদ্রলোক এখানে এসে হোটেল ম্যানেজমেন্টের কাজ তো আর পেলেন না, পেলেন ইন্ডিয়ান একটা রেস্টুরেন্টে বাবুর্চির হেলপারের কাজ | তাও, আবার ইভিনিং শিফটে | ভাবি ভর্তি হলেন ইংলিশ শেখার একটা ফ্রি প্রোগ্রামে | নতুন ইমিগ্রেন্টরা ইংলিশ কোর্সে ভর্তি হলে কিছু সরকারী ভাতা পান | ভাবিও সামান্য টাকা-পয়সা সেভাবে 'কামাচ্ছেন' | একপ্রকার সুখে-দুখে দিন গুজরান করে যাচ্ছেন তাঁরা | তার উপর আবার বাংলাদেশী কম্যুনিটির কেউ দাওয়াত দিলে সেখানেও যেতে হয়; না গেলেও নানা সমালোচনা |

এরই মাঝে বাংলাদেশে থাকা শ্বাশুড়িমা'র ইচ্ছেপূরণে সুখবরও একটা করে বসেছেন তাঁরা | মানে, তৃতীয়বারের মতো আল্লাহ'র রহমত আর কি | শ্বাশুড়িমা'র নাকি কানাডিয়ান বেবী দেখার বড় সাধ জেগেছিল | কথাটা শুনে মনে মনে হাসলাম | আব্দারের ছিরিটা দেখুন তো ! নারী-পুরুষের মিলনে বাচ্চা পয়দা হবে, তার আবার বাংলাদেশীও কি, কানাডিয়ানও কি | - ভাগ্যিস, একটা সরকারী বাড়ির বরাদ্দ পেয়ে কানাডায় একপ্রকার ফ্রি থাকার সুযোগ পেয়েছেন তারা | না হয়, এ পরিবারটার যে কি হতো ! ..

মাস তিনেক হলো শরিফ ভাইদের দেখা নেই | খোঁজ নিয়ে জানলাম, তাঁরা কানাডায় এভাবে থাকা শেষতক মেনে নেন নি | সরকারী বাড়ি ছেড়ে দিয়ে একেবারে দেশে ফিরে গেছেন | আর ফিরবেন না | তাঁদের পরিবারের জন্য এ ডিসিশন হয়তবা মঙ্গলের; কিন্তু, আমার মতো নরম মনের মানুষ, যাঁরা এ পরিবারের সাথে মিশেছেন, তাঁদের খবরটা শুনে মন খারাপই হবার কথা | এ পরিবারের উপর কিছুটা রাগও হলো মনে মনে | সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে, একটা নতুন দেশে এসে সেটেল  হতে তো কিছু সময় দিতেই হয় | রাত পোহালেই তো দিন আসে | এ সহজ কথাটা না বুঝে এভাবে পালিয়ে যেতে হয় ? বাচ্চা ছেলের মত কাজ করেছে তারা, মনে মনে ভাবলাম | শ্বশুর বাড়ির মাগনা বাসাটাই তাদের দেশে ফিরে যেতে প্রভাবিত করলো কিনা, কি জানি?  যাক, তারা তাদের জন্য যা ভালো মনে করেছে, করেছে, আমি আর এ নিয়ে ভেবে মাথা নষ্ট না করি | ..

বছর দেড়েক দেশে কাটাতেই তাঁরা আবার কানাডায় ফিরেছেন কয়েক মাস আগে | আমাদের সাথে ফোনে কথা হয়েছে | দেখাদেখি এখনো হয়নি | ক'বছর কানাডায় থেকে শরিফ দম্পতি বুঝেছেন, অনেক সমস্যার মাঝেও এসব দেশে থাকা বাংলাদেশে থাকার চেয়ে অনেক নিরাপদ |

আজ হঠাত এভাবে তাঁদের এ দোকানে দেখতে পাবো ভাবিনি | এর আগে বিভিন্ন সময়ে আরো দু'বার শরিফ ভাই-ভাবির সাথে এ দোকানে দেখা হয়েছিল আমার | এখানে তাজা বাংলাদেশী মাছ আর, হালাল মাংস পাওয়া যায় তো, তাই সবাই আসে |

প্রথমবার যখন দেখা হয়, তখন এক অদ্ভুত কান্ড ঘটল | সে কারণে ব্যাপারটা এখনো মনে আছে | সালাম দিয়ে ভাবি জানতে চাইলেন, কি কিনবেন ভাই? - বললাম, একটা রুই, আর দুটো মুরগি ..

আমি আর পাল্টা জানতে চাইলাম না, উনারা কি কিনবেন না কিনবেন | এসব জেনে আমার কাজও বা কি |

তারপরপরই ভাবি কি যেন একটু ভেবে পাশেই দাড়িয়ে থাকা ফ্রিজটা খুলে বড় একটা ইলিশ মাছ বের করে শরিফ ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, একটাতে হবে, না দুটো কিনবো?

শরিফ ভাই আমতা আমতা করে নিচুস্বরে ভাবিকে বললেন, আজ ইলিশ কিনবে?

ভাবি বিরক্তির স্বরে জবাব দিলেন, লাগবে, লাগবে ..

কথোপকথনের ধরন দেখে আঁচ করলাম, ভাবি ইলিশ মাছ কেনার ডিসিশনটা আমাকে দেখে হঠাতই নিয়েছেন, তাঁদের মূল বাজার তালিকায় এই অতি দামী আইটেমটা আসলে অন্তর্ভুক্ত ছিল না | আমাকে তাঁদের আর্থিক অবস্থা 'বেশ শক্ত' বুঝাতেই ভাবির এ অস্বাভাবিক আচরণ | বলুনতো বন্ধুরা, আমি কি একটা বাচ্চা যে এসব কিছুই বুঝি না ! আজ আমার কারণে তাঁদের আর্থিক অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে দেখে মনে মনে খারাপ লাগলো |

একইভাবে, দ্বিতীয়বার যখন এ দোকানে তাঁদের সাথে আমার দেখা হয়, তখন আমাকে দেখাতে প্রায় একশ ডলারে ভাবি আস্ত একটা খাঁসির রান কিনে ফেলেছিলেন | বলে রাখি, এখানে খাঁসির মাংস মুরগির তিনগুনের মত, আর ইলিশের দামতো আরো চড়া | তাই কালেভদ্রে মানুষ এসব জিনিস কিনে | দাওয়াত-টাওয়াতেও কেউ এসব দামী আইটেম সচরাচর দেন না | - শরিফ ভাই অবশ্য ভাবির এসব নাটকীয় ঘটনায় উদাস কিংবা বিহ্বল হয়ে তাঁর সাথে তাল মিলিয়ে চলার বাইরে কিছু করেন না | আফটার অল, বাংলাদেশে শ্বশুর বাসায় বিনে ভাড়ায় অনেক দিন থেকেছেন, মনটা একটু বেশি নরম তো হবেই |

আজ ওই দোকানে ঢুকতেই তাঁদের দেখে আগের দুটো ঘটনা মনে পড়ে গেল | ভাবলাম, নুন আনতে পান্তা ফুরায়, অথচ বড়লোকি স্বভাবের, এ ভদ্রমহিলাকে তৃতীয়বারের মতো বিব্রত না করি | তাই, তাঁদের এড়াতে দোকানের দরজা থেকেই বিদায় নিলাম | এতো ভেতরের কথা কি আর আমার ক্লাস এইটে পড়ুয়া কিশোর ছেলেকে ভেঙ্গে বোঝানো যায় ? ও হয়তো মনে করছে, তার বাবা আরেকবার ভুলোমনের পরিচয় দিলো আজ, দোকানে এসেও বাজার না করে ফিরে যেয়ে | মনে করলে করুক না; তাতে কি?

No comments:

Post a Comment