Friday, February 5, 2016

অমর একুশে বইমেলার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্ই / নন্দিতা ভৌমিক

বাংলাদেশে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গন ও সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে একুশে বইমেলা/২০১৫ শুরু হয়েছে যথারীতি ফ্রেবুয়ারি প্রথম দিন থেকে। জানা যায়, মেলা জমে ওঠে শুক্রবার ৫  ফেব্রুয়ারি থেকে। ওই ৫ দিনের মধ্যে মেলায় বহুমাত্রিক ঘরণার অন্যতম লেখক ড. মোহাম্মদ আমীনের নতুন নয়টি বই চলে আসে। বইগুলো হচ্ছে : (১) বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন, (২) দাপ্তরিক প্রমিত বাংলা বানান, (৩) বাংলা সাহিত্যের পৌরাণিক উৎস, (৪) বাংলা সাহিত্যে পুলিশের 
  ভূমিকা, (৫) ভূত- অঙ্কের জিরো থিয়োরি, (৬) মানুষ ও বিড়াল, (৭) ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স, (৮) বেত ভূতের ইন্তেকাল এবং (৯) সায়েন্স ফিকশন কিউপ্রিট। জানা যায়, ড. আমীনের আরও ৪টি বই এ বইমেলাতেই কয়েকদিনের মধ্যে স্টলে চলে আসবে। অবাক হলাম, সরকারি কর্মকর্তা হয়েও কীভাবে এতগুলো গবেষণামূলক বই তিনি লিখেন। গল্প উপন্যাস হলে অবশ্য কথা ছিল। ড. আমীনের প্রকাশিত ৯টি বইয়ের মধ্যে অতি প্রয়োজনীয় ও আকর্ষণীয় ৪টি গবেষণামূলক বইয়ের আলোচনা নিচে উল্লেখ করা হলো। বাকি ৫টি সায়েন্স ফিকশন ও রূপক গল্প। এগুলোর আলোচনা অন্যদিন করা হবে।


বাংল বানান : কোথায় কী লিখবেন

প্রথমে বলা যায় বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন। পুথিনিলয় স্টলে গিয়ে দেখলাম বইটি জনপ্রিয় লেখকের জনপ্রিয় উপন্যাসের চেয়েও বেশি বিক্রি হচ্ছে। আগ্রহে হাতে নিই, উল্টোতে থাকি পাতা। আসলেই বইটি কেনার মতো, পড়ার মতো। বাক্যে শব্দের ব্যবহার শুধু অর্থকে বিকশিত করে না, একই সঙ্গে ভাষার সৌন্দর্যকেও পূর্ণমাত্রায় পরিস্ফুটিত করে তোলে। শব্দের মান ব্যবহারের মাধ্যমে কীভাবে লেখা ও বলাকে অপূর্ব দ্যোতনায় উপস্থাপন করা যায়- তা জানার জন্য ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা ‘বাংলা বানান: কোথায় কী লিখবেন’ গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে একটি কার্যকর
সহায়ক গ্রন্থ। বাক্যে শব্দচয়ন একটি কুশলী কাজ। এমন কিছু শব্দ বা শব্দসমষ্টি আছে যেগুলো বাক্যে যথাস্থানে না-বসালে অনর্থ ঘটার সম্ভাবনা থাকে। ‘গরুর গরম দুধ’ আর ‘গরম গরুর দুধ’ এককথা নয়। এ রকম আরও বহু নজির উপস্থাপন করা যায়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে একই শব্দ বাক্যে স্থানভেদে ভিন্ন অর্থ ধারণ করতে পারে। অনেকে এসব চিন্তা না-করেই বাক্যে ইচ্ছেমতো শব্দ বসিয়ে দেন। ফলে সুন্দর বাংলা, অসুন্দর অর্থ ধারণ করে হাস্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। মূলত এসব বিষয়ে একটি সম্যক ধারণা প্রদানই গ্রন্থটির উদ্দেশ্য। সেদিকে লক্ষ রেখে আলোচ্য গ্রন্থে আদর্শ বাক্যচয়নে শব্দের মান-ব্যবহার এবং শব্দের ব্যাখ্যাময় ব্যুৎপত্তি ও উদাহরণসহ আলোচনা করা হয়েছে। গ্রন্থটির সম্পর্কে হায়াৎ মামুদ বলেছেন : এখানে বাংল ভাষা ও বাংলা শব্দের প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এত অধিক সংখ্যক শব্দ নিয়ে এরূপ পার্থক্য ও প্রয়োগ-বিশ্লেষণাত্বক গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যে আর আছে কিনা আমার জানা নেই। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, লেখক, পেশাজীবী, সাধারণ মানুষÑ যেই হোন না, বাংলা ভাষার সৌকর্ষময় প্রকাশ আয়ত্ত করতে আগ্রহী সবার কাছে এটি একটি আকর গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত হবে। 

দাপ্তরিক প্রমিত বাংলা বানান নির্দেশিকা

‘দাপ্তরিক প্রমিত বাংলা বানান নির্দেশিকা’ ড. মোহাম্মদ আমীনের আর একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ। বিষয় বিবেচনায় এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বই।  সরকারি- বেসরকারি সকল প্রকার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শুদ্ধ ও প্রমিত বানান চর্চা এবং মান বাংলা প্রয়োগে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। অবিশ্বাস্য ও লজ্জাকর হলেও সত্য
যে, ইদানীং বাঙালি জীবনের প্রাত্যহিক কর্মকা-ে মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা ও স্বেচ্ছাচারিতা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। এমনকি উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের দ্বারা বিন্যস্ত দাপ্তরিক কর্মকা-েও বাংলা ভাষার প্রমিত প্রয়োগে লজ্জাকর অবহেলা, অসহনীয় স্বেচ্ছাচারিতা এবং অবিশ্বাস্য অজ্ঞতা লক্ষণীয়। মাঝে মাঝে এমন ভুল দেখা যায়, যা বাঙালি হিসাবে নিজেদের ঐতিহ্য ও ত্যাগকে উপহাস করে। এমন আচরণ জাতীয় জীবনের মূল উৎসধার হিসাবে চিহ্নিত সাংস্কৃতিক পরিম-লের বিহ্বল নান্দনিকতায় কুঠারাঘাত বললেও অত্যুক্তি হয় না। এটি শুধু লজ্জা নয়, বলা যায় আমাদের চরম লজ্জা। এমন লজ্জা হতে উত্তরণের প্রয়াস হিসাবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে দাপ্তরিক কর্মকা-ে প্রমিত বাংলার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য বাংলা একাডেমি প্রমিত বানান বিধিার আলোকে বিবিধ নির্দেশনা প্রদান করেছে। এ নির্দেশনার আলোকে ড. মোহাম্মদ আমীন দীর্ঘ গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞানের সঙ্গে প্রায়োগিক অভিজ্ঞতার সমন্বয় ঘটিয়ে ‘দাপ্তরিক প্রমিত বাংলা বানান’ গ্রন্থটি রচনা করেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে শুরু করে সরকারি, বেসরকারি নানা দপ্তরে প্রমিত বাংলা প্রয়োগে যে সীমাবদ্ধতা দেখা যায়, তা দূরীভূত করার জন্য এ গ্রন্থটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে। প্রত্যেক বাঙালির বইটি সংগ্রহে রাখা প্রয়োজন।


বাংলা শব্দের পৌরাণিক উৎস

‘বাংলা শব্দের পৌরাণিক উৎস’ বইটা পড়ে ভিন্ন এক অনুভূতি সৃষ্টি হলে। আমাদের বাংলা শব্দ প্রত্যেকটি এক একটি কাহিনি, কাহিনির শিরোনাম যেন। বাংলা ভাষায় অনেক পৌরাণিক শব্দ রয়েছে। গ্রন্থটিতে সে শব্দগুলোর উৎস-কাহিনি সাহিত্যরস সমৃদ্ধ সৌকর্যে প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। প্রতিটা ভুক্তি যেন এক একটা অণুগল্প। একটি পড়লে আর একটি পড়ার আগ্রহ প্রবল হয়ে ওঠে। নামটি দেখে পাঠক যাই ধারণা করুন না কেন, পড়ার পর বোঝা যায়, লেখক কী যতœসহকারে বাংলা শব্দের উৎপত্তি ও বিকাশ  নানা জানা-অজানা তথ্য দিয়ে গল্পচ্ছলে তুলে ধরেছেন। অনেকগুলো বেশ রোমাঞ্চকর ও আনন্দদায়ক। আমি মনে করি বইটি শুধু বয়স্কদের নয়, শিশু-কিশোরদেরও আগ্রহ সৃষ্টি করবে। শব্দের পরিবর্তন কেন এবং কীভাবে হয় তা প্রত্যেকটি ভুক্তিতে যুক্তিসহকারে বর্ণনা করা হয়েছে। শুধু ভারতীয় পুরাণ নয়, ল্যাটিন, চীনা, আরবীয়, মিশরীয়, গ্রিক, রোমান, ফারসি, পর্তুগিজ, ইংরেজ,
আফ্রিকান এমনকি মার্কিন ও অস্ট্রেলীয় পুরাণেরও এমন অনেক শব্দের উৎস-বিবরণ বইটিতে  দেওয়া হয়েছে যেগুলো আমরা প্রাত্যহিক নানা কাজে হরদম ব্যবহার করি। সে হিসাবে গবেষকদেরও বইটি কাজে লাগবে। ড. মোহাম্মদ আমীন বাংলা বানান ও বাংলা শব্দ নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত গবেষণা করছেন। বাংলা বানান নিয়ে তাঁর একাধিক গ্রন্থ আছে। ইতোপূর্বে তার বেশ কয়েকটা বই আমি পড়েছি। এরমধ্যে ‘রঙ্গ রসে বাংলা বানান’ বইটির কথা না-বললেই নয়। এ গ্রন্থে তিনি বাংলা বানানের বিভিন্ন অসঙ্গতি ও খুঁটিনাট দিক হাস্যরসের অফুরন্ত খোড়াকসহ তুলে ধরেছেন। এ গ্রন্থেও লেখকের সে রসপ্রিয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। অনেকে বই কিনেন শুধু সংগ্রহের জন্য। তবে ‘বাংলা শব্দের পৌরাণিক উৎস’ নিলে ক্রেতা শুধু সংগ্রহ করে সন্তুষ্ট থাকতে পারবেন বলে মনে হয় না। দু-একটা ভুক্তি পড়লে পুরোটা পড়ার আগ্রহ জাগবে। আমি মনে করি বইটি বাংলাভাষী প্রত্যেক পাঠকের কাছে একটি আকর্ষণীয় সংগ্রহ হিসাবে বিবেচিত হবে। 


বাংলা সাহিত্যে পুলিশের ভূমিকা
বইয়ের নাম ‘বাংলা সাহিত্যে পুলিশের ভূমিকা’ নাম দেখে ভারী কৌতুহল জাগল। পুলিশ আবার কীভাবে সাহিত্যে ভূমিকা রাখে? তারা তো সারারক্ষণ লাঠি আর বন্ধুক নিয়ে মানুষ তাড়ায়, রাজনীতিবিদদের নির্দেশে কাজ করে।
তাহলে কী লেখক পুলিশেকে লাঠিপেঠার মাধ্যমে সাহিত্যে ভূমিকা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন? না, পড়েই বুঝলাম বিষয়টা ভিন্ন এবং খুবই গুরত্বপূর্ণ। যা, আমারও এমনভাবে জানা ছিল না। পুলিশ বিভাগে কর্মরত যে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী সাহিত্যকর্ম বা অন্যান্য কর্মকা-ের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে বাংলা সাহিত্যের প্রচার-প্রসারে অবদান রেখেছেন তাদের কর্মকা- বিশ্লেষণ গ্রন্থটির বিষয়বস্তু। তাই এটি শুধু জীবনীগ্রন্থ নয়, গবেষণাগ্রন্থও বটে। তবে এমন কয়েকজন ব্যক্তির কর্মকা- এখানে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যারা প্রত্যক্ষভাবে পুলিশ বিভাগের সদস্য না-হলেও পুলিশ বিভাগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। পুলিশ না-হলেও যারা পুলিশ বিভাগের কাজ করেছেন তেমন সাহিত্যিক কারণিকদের জীবনীও এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।  সূচিসজ্জা বাংলা বর্ণমালার বিন্যাস অনুসারে সজ্জিত করা হলেও আভিধানিক ক্রমতা রক্ষা না-করে জন্ম তারিখ অনুসারে বিন্যস্ত করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের বিকাশে প্রথম থেকে পুলিশ বিভাগের বিভিন্ন পদমর্যাদার সদস্যবৃন্দ অবদান রেখে আসছেন। লেখক ভূমিকায় বলেছেন, তথ্য-ঘাটতির জন্য অনেকের নাম এ খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবু ৭২ জনের জীবনী ও সাহিত্যকর্ম  নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।  এটি এ সংক্রান্ত প্রথম গবেষণা বিবেচনায় যথেষ্ট এবং নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।

নন্দিতা ভৌমিক : পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার লেখিকা, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।


No comments:

Post a Comment