Monday, February 1, 2016

স্কুলিং: এদেশ, ওদেশ / এম এল গনি

স্কুলিং: এদেশ, ওদেশ

আমার মত যাঁরা দেশ ছেড়ে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন, তাঁদের অনেককেই বলতে শুনি, দুর্নীতিমুক্ত সৎ জীবনযাপনের জন্যই নাকি তাঁরা দেশ ছেড়েছেন | আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, পরবর্তী প্রজন্ম, তথা বাচ্চা-কাচ্চাদের উন্নত পড়ালেখা এবং ঝামেলামুক্ত উজ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তাঁরা প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়েছেন | সত্যি বলতে দ্বিধা নেই, আমার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কারণটিই ছিল মুখ্য | কারণ, বুদ্ধির বয়স থেকেই দুর্নীতির পরিবেশে বেড়ে উঠে দুর্নীতি অনেকটা গা-সহা হয়ে পড়েছিল | দুর্নীতি বিষয়টা অনৈতিক হলেও তার সাথে
তাল মিলিয়ে চলতে খুব বেশি খারাপ বা অস্বস্তি লেগেছে বললে আসলে ঠিক বলা হবে না; বায়ু সাগরে বাস করেও যেমন বায়ুর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না, সে রকম কিছু আর কি | - আজ প্রায় দেড়দশক পরে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, যে বাচ্চাকাচ্চার কথা ভেবে কাছের সবাইসহ প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে আসা, তাদের পড়াশোনা বাস্তবে কেমন চলছে, বা এদেশের (কানাডা) পড়ালেখার সাথে বাংলাদেশের বিশেষ পার্থক্যই বা কোথায় ? - বন্ধুরা, বিচ্ছিন্ন কয়েক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সে বিষয়ে আপনাদের কিছু ধারণা দেয়ার প্রয়াস চালাবো এ লেখায় | 

আমাদের দু'বাচ্চা স্কুলে যায় | একজন ওয়ানে, অপরজন ক্লাস এইটে | ওয়ানের কথা বাদই দিলাম; সবে স্কুল শুরু করেছে | এইটের জনের কথাই বলি | ওর মুখে প্রায়ই শুনি, হোম ওয়ার্ক বা, বাড়ির কাজ নেই; সবকাজ স্কুলেই সেরে এসেছে | - এ কেমন কথা বন্ধুরা? বাংলাদেশে আমি নিজে যখন ক্লাস এইটে পড়তাম তখন রাতদিন খেটেও বাড়ির কাজ শেষ করে কুল পেতাম না | কত বিষয় আমাদের পড়তে হতো, বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সমাজ, বিজ্ঞান, ধর্ম, কৃষি, .. কত কী ? ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাবার আগেই দু'তিন ঘন্টা পড়ালেখা, স্কুল শেষ করে প্রাইভেট পড়তে যাওয়া, অঙ্ক শেষ করে ইংরেজির টিউটর, ইংরেজি শেষ করে .., তারপর বাসায় ফিরে আবার রাত দশ-এগারোটা পর্যন্ত পড়ালেখা | কী গাধার খাটুনিই না খেটেছি | এত পড়ালেখা করেও মা-বাবাকে খুশি করা সহজ ছিল না | তারা কেবলই বলতেন, আরো পড়, আরো পড় | সেকি ব্যস্ততারে বাবা ! ভাবলে এখনো গা শিউরে উঠে | আর, আমাদের এ ছেলেটা কিনা স্কুল থেকে ফিরেই লেগে যায় কম্প্যুটার গেইম, মুভি দেখা, ছোটভাইয়ের সাথে খেলাধুলা, বা বড়জোর গল্পের বই নিয়ে সোফায় বসে পড়া | আর বলে, স্কুলেই বাড়ির কাজ শেষ করে এসেছে | কাজ থেকে ফিরে এসব দেখে মাঝে মাঝেই মেজাজটা বিগড়ে যায় | অথচ, এদের উন্নতমানের পড়াশোনা নিশ্চিত করতেই কিনা দু'টো ফকফকা উজ্বল ভবিষ্যতের সরকারী চাকুরী ফেলে আমাদের সুদুর কানাডায় আসা |

সেদিন বাচ্চাদের মা'র সাথে কথা বললাম ওদের পড়ালেখার ভবিষ্যত নিয়ে | অনেকদিনের জমে থাকা ক্ষোভ-কষ্ট মন খুলেই ঝেড়ে দিলাম | ওকে এও বললাম, এ ঢিলেঢালা লেখাপড়ায় বাচ্চাদের কোনো ভবিষ্যত দেখি না | প্রতিদিন দু'চার ঘন্টা ব্যস্ত থাকার মত বাড়ির কাজও না দিলে এ আবার কেমন পড়ালেখা ? স্কুলে পরীক্ষা-টরীক্ষা নেই, প্রাইভেট টিউটর নেই, শাস্তি নেই, বকাঝকা নেই .. এই পড়ালেখার জন্যই কি গাদাগাদা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে এ বিদেশ বিভুয়ে পাড়ি জমিয়েছি ? অথচ, এদেরই বয়সী বাচ্চারা দেশে পি.এস.সি., জে.এস.সি., এস.এস.সি., এইচ.এস.সি., কত শতরকমের পরীক্ষাই না দিচ্ছে; আর, এ প্লাস, গোল্ডেন এ প্লাস, এ ডবল প্লাস, .. ইত্যাদি পেতে রাতের ঘুম হারাম করছে | এদিকে, আমাদের কানাডায় বাস করা ননীর পুতুলগুলো কিছুমাত্রও কষ্ট না করে, অনেকটা হেসেখেলেই একের পর এক ক্লাস পেরিয়ে অবলীলায় উপরের শ্রেণীগুলোতে উঠে যাচ্ছে | এদেশে একাদশ শ্রেণী পর্যন্ত নামমাত্র যে পরীক্ষাগুলো আছে ওসব পাশ না করেও নাকি পরের ক্লাসে উঠা যায় | - এ কেমন কথা?

বছর পাঁচেক আগে যখন দেশে বেড়াতে গেছি তখন ঢাকায় আমার এক ফুফাত ভাইয়ের বাসায় দু'দিন ছিলাম | তখন দেখেছি তাঁদের ক্লাস নাইনে পড়ুয়া মেয়ে হেমা'কে কত কষ্ট করে ইংলিশ কম্প্রিহেনশন মুখস্থ করছে | খাতার এক পৃষ্ঠায় ছয়টা প্রশ্ন লেখা আছে, আর পরের পৃষ্ঠাগুলোয় লেখা আছে প্রশ্নের ক্রমানুসারে উত্তর | কোনো ভুলভালের প্রশ্নই আসে না, কারণ টিউটর নিজেই সব রেডি করে দিয়েছেন | খোলা জানালায় আকাশের দিকে তাকিয়ে হেমা উচ্চস্বরে প্রশ্নগুলো মুখস্থ করে যাচ্ছে একে একে, তারপর উত্তর | আমি খানিক দুরেই চেয়ারে বসে চা খাচ্ছি | 

রান্নাঘরের দিক থেকে ভাবি এসে আমাকে বললেন, হেমা কিন্তু ক্লাসে সেকেন্ড হয়েছে গতবছর | ওর ইংরেজি পড়াটা শুদ্ধভাবে হচ্ছে কিনা একটু দেখবেন? আপনারা তো ইংলিশ দেশে থাকেন | 

ভাবির অনুরোধে হেমার সাথে কথা বলে বুঝলাম, প্রশ্ন বা, উত্তরের মানে বোঝার কোনো বিষয় এখানে নেই | আগ্রহের বশে হেমাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা মনি, তো প্রশ্নটা যদি একটু ঘুরিয়ে দেয় তখন কিভাবে বুঝবে কোন প্রশ্নের কি উত্তর? 

ওর ঝটপট উত্তর: চাচ্চু, প্রশ্ন ঘুরিয়ে কিভাবে দিতে পারে তাও টিউটর আমাকে বলে দিয়েছেন | 

মেয়ের রেসপন্স শুনে বুঝতে দেরী হলো না, ঢাকা শহরের কোনো নামকরা টিউটরের কাছেই সম্ভবত হেমা ইংলিশ প্রাইভেট পড়ছে | কথায় আছে না, টাকা থাকলে বাঘের চোখও মেলে | আহ, কি সুন্দর পড়ালেখা ! আমার ছেলেটাকে কানাডা থেকে নিয়ে এসে ফুফাত ভাইয়ের এখানে দিয়ে দেবো নাকি? তাও মনে আসছে |

আজও মনে আছে, প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে আমরা তিন ভাইবোন মিলে মুখস্থের বিষয়গুলো আগে সেরে ফেলতাম | মুখস্থ হয়ে গেলে একে অন্যের সাহায্য নিয়ে নিশ্চিত করতাম, দাঁড়ি, সেমিকোলনসহ সবকিছু ঠিকভাবে বলতে পেরেছি কি না | আমার বড় ভাইটা করতো কি, মুখস্থ বলার সময় কোথায় দাঁড়ি, কমা আছে ওগুলোও মুখে উচ্চারণ করে বলতো; তা শুনে আব্বা মাঝে মাঝে হাসতেন | আর, আমার মেজ আপাকে দেখতাম গলায় ফাঁস দেয়ার মত করে একটা গামছা বেঁধে ওখানে মুখ ঢুকিয়ে সিলিংফ্যানের রডে একপ্রকার ঝুলে থেকে রাত গভীরে মরণপণ পড়াশোনা করতে | উদ্দেশ্য, চোখে ঘুম এলেও যেন মাথাটা ঢলে না পড়ে | পরীক্ষায় একটু ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য সে কি প্রানান্ত প্রচেষ্টা আমরা ভাইবোনরা চালিয়েছি | অথচ, আজ এই উন্নত দেশে দেখি আমাদের বাচ্চারা নম্বর-টম্বরের বিষয়ে বিন্দুমাত্রও তোয়াক্কা করে না | আর, উদ্বিগ্ন হবেই বা কেন? এখানের স্কুলে তো এক অর্থে পাশ ফেল বলে কিছু নেই | বছর শেষে গণহারে সবাই এক ক্লাস থেকে আরেক ক্লাসে পদোন্নতি পেয়ে যায় | ক্লাসে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হওয়া, এসবও এখানে নেই | 

আগেই বলেছি, এক ক্লাস থেকে আরেক ক্লাসে উঠতে এখানে নিয়মিত স্কুলে যাওয়া আসা করলেই চলে | স্কুল কর্তৃপক্ষ বাচ্চাদের বছর শেষে উপরের ক্লাসে তুলে দিতে একপ্রকার বাধ্য | এভাবে চলে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত | নামমাত্র পরীক্ষাগুলোতে কোন বাচ্চা কী ফলাফল করলো, 'এ' পেলো, কি 'বি' পেলো, বা আদৌ কিছু পেলো কিনা, তা কিন্তু অন্য বাচ্চাদের জানার উপায়, বা আগ্রহও নেই | এদেশে এসব একান্ত 'ব্যক্তিগত তথ্য' যা অন্যের সাথে শেয়ার করার নিয়ম নেই | টিচাররাও একজনকে অন্যের ফলাফল বলতে পারেন না | অথচ আমাদের দেশে বাচ্চারা যখন জিপিএ ৫, বা গোল্ডেন এ ডবল প্লাস, ইত্যাদি পায়, তখন মা বাবারা বুক ফুলিয়ে সবাইকে বলে বেড়ান, বা অনেক সময় টাকা পয়সা খরচ করে বড় বড় সব পত্রিকায় এ রেজাল্টের খবর ফলাও করে প্রচারও করেন | অথচ, এখানে কাউকেই জিজ্ঞেস করার সাহস করতে পারি না তাঁর বাচ্চাটা পরীক্ষায় কী করেছে না করেছে; পার্সোনেল ইনফরমেশন জানতে চেয়ে পাছে আবার কোন বিপদে পড়ি | সেকারণে রহিম সাহেবের ছেলে জলিল সাহেবের মেয়ের চেয়ে এগিয়ে না পিছিয়ে, তেমন তুলনা করার সুযোগও অনুপস্থিত |

এক হতভাগ্য টিচারের ঘটনা শুনুন, কিছুদিন আগে এখানের এক স্কুল টিচার কোন এক ছাত্রকে অঙ্কের পরীক্ষায় শুন্য (যাকে ভালো বাংলায় অনেকে 'অশ্বডিম্ব' বলে থাকেন) দিয়ে পড়েছিলেন মহা বেকায়দায় | শিক্ষক মহোদয়কে তাঁর এই 'ক্ষমার অযোগ্য' অপরাধের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছিল বেশ লম্বা সময়ের জন্য | কারণ, ছাত্র পরীক্ষায় যত খারাপই করুক না কেন, স্কুল বোর্ডের নিয়মমতে নাকি কাউকে শুন্য দেয়া যায় না | কেননা, এতে ওই ছাত্রের প্রতি চরম অশ্রদ্ধাজ্ঞাপন হয় | বাহ, স্কুলের মাছুম বাচ্চাদেরও কী সম্মান এসব উন্নত দেশে ! ওদিকে, আমাদের দেশের কথা একবার ভাবুন তো ! ভুল উত্তর দেয়া ছাত্র শুন্য তো পাবেই, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হাস্যকর |  তার উপর, এ শুন্য নিয়ে বাড়ি ফিরে বাবা মা'র কাছে যে বিশেষ ট্রিটমেন্ট'টা ওই বাচ্চা পাবে তা ভেবে অনেক বাচ্চা এ অবস্থায় বাড়ি ফিরতেই ভয় পায় | কি, ঠিক বলিনি বন্ধুরা?

এখানে প্যারেন্ট-টিচার মিটিং হয় বছরে দু'বার | ছাত্রের পড়াশোনার অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে টিচারের সাথে ছাত্র বা ছাত্রীর অভিভাবকের সাক্ষাত | সাধারণত আমার স্ত্রী এসব মিটিঙে যেয়ে থাকে; আমি পারতপক্ষে যাই না | ভাবলাম, আর কতকাল এসব এড়িয়ে চলবো, আমার অবহেলায় যে ছেলের ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে | এসব মিটিঙে ওদের মাকে পাঠিয়ে বিশেষ ফল না হবার ভেতরের খবরটা কিন্তু আমার বেশ জানা | ও নিজেও তো টিচার | বোধগম্য কারণেই, এক টিচার কী আরেক টিচারের দোষ ধরতে যাবে ? - না, সে কী করে হয়? পুলিশের তদন্ত পুলিশ দিয়ে করলে ফল কী হবে সে তো সবারই জানা | তাই, এবারের মিটিঙে আমিই গেলাম | বাসা থেকে বেরুবার আগে আমার স্ত্রী আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিলো, মাথা গরম না করে টিচারের সাথে শান্তভাবে কথা বলতে, টিচারের বক্তব্য ভালোভাবে শুনতে, সর্বোচ্চ লেভেলের প্রফেশনালিজম মেনটেইন করতে .. কত কী !

আমাদের জন্য আগে থেকেই একঘন্টা সময় নির্ধারণ করা ছিল | যথাসময়ে ছেলেকে নিয়ে আমি হাজির | মিস পেটারসন আমার ছেলের ক্লাস টিচার | হ্যালো বলে মনভোলা এক হাসি দিয়ে আমাকে সোজা ক্লাস রুমে নিয়ে গেলেন | ছেলেসহ আমি তাঁর মুখোমুখি বসলাম | তাঁর কথা মন দিয়ে শুনছি | এ বছরের এ সময় পর্যন্ত কী কী বিষয়ে পড়াশোনার প্ল্যান ছিল, কত সুন্দর, সুষ্ঠুভাবে প্ল্যানের বাস্তবায়ন হয়েছে, আমার ছেলে কি কি নতুন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছে, কোন বিশেষ ক্ষেত্রে সে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে, শিক্ষাবছরের বাদবাকি অংশের পরিকল্পনা কি .. সেসব নিয়ে বলে চলেছেন মিস পেটারসন | মুখরোচক গল্পের সে কি দীর্ঘ তালিকা ! বক্তব্য শেষ করে ছেলের কাজের কিছু নমুনা দেখাতে আমাকে ক্লাসরুমের ভেতরে এদিক ওদিক নিয়ে গেলেন | আর্ট কর্নারে আর্টের কাজ, ক্রিয়েটিভ রাইটিন্গের বেশ কিছু নমুনা, সায়েন্স সেন্টারে বিজ্ঞানের কাজ ..; ঘুরেফিরে আবার বসলেন আমাকে নিয়ে | এবার আমার ফিডব্যাক বা, মতামত দেবার পালা |

কথার ফুলঝুরিতে আমার মন ভোলানোর যত প্রচেষ্টাই মিস পেটারসন (পেট) চালান না কেন উনি কি আর বাঙালির সাথে চালাকিতে এঁটে উঠবেন ? কক্ষনোই না | উনি হয়ত ভাবছেন, সারা বছরের ফাঁকিবাজি ঢেকে দেয়ার জন্য আমার সাথে কিভাবে চালাকি করেছেন তা আমি বুঝছি না | ছেলে বাসায় পড়াশোনা বলতে কিচ্ছু করে নাই, তারপরেও জ্ঞানার্জনের শতভাগ লক্ষ্য অর্জিত হয়ে গেছে দাবি করে উনি আমাকে যে তথ্য প্রমানাদি দেখালেন তা দেখে সাময়িক পুলকিত হলেও বাড়ির কাজ কেন দেন না তা ভেবে রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে গা'টা রি রি করছিল | তাও স্ত্রীর কথা মেনে সবকিছু হজম করে মুখমন্ডলে জোরজবরদস্তির মেকি হাসি বজায় রেখে চলেছি | বাঙালি বিদেশে এসে যে কত সহনশীল-ভদ্রলোক হয়ে যায়, সে বিষয়ে আমার নিজের চেয়ে বড় প্রমান আর দেখছি না আপাতত | চুন থেকে পান খসলেই তো আমরা জ্বলে উঠি, কিসের প্রফেশনালিজম, কিসের কি? মেজাজ হারানো প্রসঙ্গে আমাদের এক মাননীয়া সাংসদের ঘটনা মনে পড়ে গেল | নিজের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া বিষয় | মনের চোখে এখনো দৃশ্যগুলো জ্বলজ্বল করছে |

অনেক বছর আগের কথা | তখন আমি সরকারী অফিসার | মাঝে মাঝে অফিস থেকে দেয়া ড্রাইভারকে পাশের সিটে বসিয়ে আমি নিজেই গাড়ি চালিয়ে এদিক ওদিক যেতাম | তেমনই যাচ্ছিলাম দক্ষিন চট্টগ্রামের আরাকান সড়ক ধরে কক্সবাজারের দিকে | পটিয়ার কাছাকাছি রৌশন হাটে যানজটে পড়ে গাড়ি আটকে গেল | সামনে বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে | প্রথমটায় মনে হলো দুর্ঘটনা ঘটনা ঘটেছে এখানে | ভালো করে তাকাতেই দেখি, সে রকম কিছু না | স্থানীয় এক মহিলা এমপি'র থেমে থাকা গাড়ি দ্রুত ছেড়ে যেতে দেখলাম ওই স্পট থেকে | আর, বাইশ-তেইশ বছরের এক যুবক রিক্সাওয়ালা তার রিক্সার পাশে দাড়িয়ে এমপি সাহেবার চলমান গাড়ির দিকে চোখ রেখে কাঁদো কাঁদো গলায় কি যেন বলছে | আমার ড্রাইভার দীপক বড়ুয়া'কে বললাম একটু দেখে আসতে ঠিক কি ঘটেছে এখানে | দীপক ওই যুবকের সাথে কথা বলছে, যুবক দেখি রাগে-ক্ষোভে থরথর কাঁপছে | অবশ্য রাগটা দীপকের উপর নয়, মাননীয়া এমপি'র উপর | স্পষ্ট কানে এলো, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় মাননীয়া সাংসদকে উদ্দেশ্য করে টগবগে এ তরুণ চিত্কার করে বলছে, 'মাগী এদিন্না আঁরঅ ঘরত আইস্সে দে ভোট মাগিবাল্লায়, আর আজিয়া আঁরে ধরি মারের ..|" (অর্থ: এই খারাপ মহিলাটা এই সেদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিল ভোট চাইতে, আর আজ আমাকে ধরে মারছে |)

দীপকের কাছে জানলাম, মাননীয়া সাংসদকে বহনকারী গাড়িকে সাইড দিতে রিক্সাটা নাকি একটু বেশি সময় নিয়ে ফেলেছে | তাই, উনি রেগে গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে রিক্সাওয়ালা যুবকটাকে কষে কয়েকটা থাপ্পর লাগিয়ে দিয়েছেন | ঘটনাটা শুনতেই নিজের অজান্তে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, 'মহিলা মানুষ, একটা যুবক ছেলের গায়ে এভাবে হাত না তুললেও পারতেন |' আমার এ মন্তব্যের সুযোগ নিল দীপক | সাথে সাথে সেও পাল্টা মন্তব্য ছুড়ে দিল, 'স্যার, এমপি সাহেবার সাথে স্বামীর সম্পর্ক ভালো না | উনারা প্রকাশ্যে ঝগড়াঝাটি করেন, আলাদা থাকেন |'

আর কথা না বাড়িয়ে চুপ মেরে গেলাম, দীপক আবার কি বলতে কি বলে | সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে ওকে কিছুটা শাসন করারও তাগাদা অনুভব করে বললাম, দীপক, আমরা সরকারী চাকুরে | একজন মাননীয়া সাংসদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এভাবে মন্তব্য করতে পারি না; তোমার সরি বলা উচিত | নিচুস্বরে নিচের দিকে তাকিয়ে দীপক বলল, সরি স্যার, সরি |

ছাত্রদের সারাবছর ঠিকমত পড়ালেখা না করিয়েও নানা কথামালায় আমাকে মিস পেটারসন যেভাবে খুশি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তা দেখে রাগে ভেতরে ভেতরে রক্তচাপ তুঙ্গে উঠলেও আমার স্ত্রীর কথামতো প্রফেশনালিজম মেনটেইন করতে যেয়ে অনেকটা নিরবতা পালন করতে হচ্ছে আমাকে; মাননীয়া সাংসদের আদলে রাগ প্রকাশের সুযোগ এখানে নেই | 

তাঁর বক্তব্য শেষ করে টিচার আমার কোনো মন্তব্য বা, প্রশ্ন আছে কিনা জানতে চাইলেন | ভাবলাম, কিছুই না বলে এ সুযোগটা হাতছাড়া করা ঠিক হবে না | ছেলের পড়ালেখায় তেমন উন্নতি হবে না জেনেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মিস পেটারসনকে দু'টো কথা শুনিয়ে দিতে মনটা আঁকুপাঁকু করে উঠলো |

তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে জানতে চাইলাম, আপনারা যে বাচ্চাদের হোমওয়ার্ক এতো কম দেন, এর কারন কি ?

স্কুল বোর্ডের গাইডলাইন মেনে যতটুকু দেয়ার তাই দেই | যারা ক্লাসেই কাজগুলো শেষ করে ফেলে ওদের বাসায় যেয়ে আর কিছু করতে হয় না | আপনার ছেলেকে তাই বাসায় তেমন কিছু করতে দেখেন না, হি ইজ রিয়েলি স্মার্ট .. এটুকু বলে মুচকি হেসে বললেন, গর্ব করার মতো ছেলে আপনার |

রসিকতার একটা সীমা আছে তো বন্ধুরা ! তাও বললাম, থ্যান্ক ইউ থ্যান্ক ইউ মিস পেট | পাশে বসা ছেলেটা মনে হয় আমার মনের ভেতরের খবর জানে | ঠিক এ সময়টায় ও আরচোখে আমার দিকে এক পলক তাকালো |

তারপর কিছুটা ইতস্তত করে বললাম, দেখুন, আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার . তো আমার ছেলেকেও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা এরকম কিছু একটা তো হতে হবে | কিন্তু, এত কম হোমওয়ার্ক করে ওকি ভবিষ্যতে সে লেভেলের কিছু হতে পারবে? ..

- আপনার বাচ্চা তো বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, এসব হতে নাও চাইতে পারে, এটাতো নির্ভর করছে তার চয়েস এর উপর, নাকি? 

ছি:, কাকে কি বলছি আমি ? এই মহিলার তো দেখি গোড়ায় গলদ, তা ছাড়া, ছেলের সামনেই এ ধরনের কথা ? মনের এই গোপন ইচ্ছেটা তার সাথে শেয়ার করাটাই তো ভুল হয়েছে মনে হয় | ছেলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে না মানে? .. এ মহিলার কেমন আস্পর্ধা দেখুন বন্ধুরা !

একটু থেমেই মুচকি হেসে মিস পেট আবার বলতে শুরু করলেন, আপনারা যে দেশ থেকে এসেছেন সেখানে মনে হয় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের বেশ সম্মানের চোখে দেখা হয়, তাই না?

'হ্যা, হ্যা, তাই তো, আপনি ঠিক বলেছেন ..', দেরিতে হলেও আমাকে বুঝতে পেরেছেন দেখে এক ঝলক কোমল আনন্দ মনের গভীরটা ছুঁয়ে গেল | ভদ্রমহিলা আসলে যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ততোটা না |

পরক্ষনেই আবার বলতে শুরু করলেন, এদেশে কিন্তু সব কাজই সম্মানের | ঝাড়ুদার আসতে দেরী করলে অনেক সময় আমাদের প্রিন্সিপ্যাল সাহেবও স্কুলের বারান্দা ঝাড়ু দিতে লেগে যান; আপনি নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন |

মাথা নেড়ে সম্মতিসূচক জবাব দিলাম | 

উনি বলে চলেছেন, আমরা তো বাচ্চাদের বারবার বলি, তোমরা নিজেরা যা হতে চাও তাই হতে চেষ্টা করো জীবনে, বাবা মা বা, অন্য কেউ তোমাকে কি হিসেবে দেখতে চান ওটা মাথায় নিও না | অলওয়েজ ট্রাই টু বি ইউরসেল্ফ |

তাই? তাহলে আপনি বলছেন, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ঝাড়ুদার, সব এক?

কাজে ভিন্নতা আছে অবশ্যই, তবে সম্মানের দিক থেকে কেউ কারো চেয়ে কম নয় | যেমন ধরুন, একটা হাসপাতালে ডাক্তারের যেমন দরকার, ঝাড়ুদারও তেমনই দরকার | দুজনের কাউকে ছাড়াই হাসপাতাল চলবে না | আমাদের সমাজে সব ধরনের পেশার লোকেরই চাহিদা আছে, সম্মান আছে, আমরা সকলেই একে অন্যকে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছি, কাউকে ভিন্নচোখে দেখার অবকাশ নেই  এখানে; উই আর নাথিং বাট এ বিগ টিম হেল্পিং ইচ আদার |

কথাগুলো বলতে মিস পেট-এর চেহারায় ফুটে উঠা গাম্ভীর্য্য আর দৃঢ়তা এখনো চোখে ভাসছে; সফেদ বরফে সোনালী রোদের আলো যেমন উজ্বলতার ঝিলিক তোলে, তেমনই দৃপ্ত তাঁর চোখজোড়া |

আরেকদিনের ঘটনা | ছেলে তখন ক্লাস সিক্সে পড়ত | স্কুল থেকে এক চিঠি এনে ওর মাকে দিল | পরে ওর মা দিয়েছে আমাকে | দু'পাতার চিঠি | এক পাতায় লেখা আছে কিছু তথ্য; অপর পাতায় একটা সম্মতি পত্র | ইয়েস, বা নো লিখে স্বাক্ষর করে টিচারের কাছে ফেরত দিতে হবে |

চিঠিতে লেখা আছে, আপনার বাচ্চার এখন যে বয়স, সে বয়সে বাচ্চারা যৌন বিষয়ে জানতে আগ্রহী হয় | বারো তের বছর বয়স থেকেই অনেক শিশু যৌনমিলনেও অভ্যস্ত হয়ে পড়ে | সে কারণে তাদের নিরাপদ যৌন জীবন ও যৌন স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞানদান একান্ত আবশ্যক | তবে, যেহেতু আপনি এ বাচ্চার অভিভাবক, এবং এ বাচ্চা এখনো অপ্রাপ্ত বয়স্ক, আপনি না চাইলে তাকে এখনই যৌন শিক্ষার এ ক্লাসে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না | তাই, 'হ্যা' বা, 'না' উল্লেখ করে চিঠিটি টিচারের কাছে সত্বর ফেরত দিন |..

এ চিঠি পড়ে তো চোখে সর্ষে ফুল দেখার অবস্থা ! একি দেখছি, একি পড়ছি, 'একি সত্য সকলি সত্য ..' ! এমন নির্লজ্ব, বেহায়া হতে পারে এরা? - আবার এও মনে পড়ল, কয়েক দশক আগে আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, তখন এক সহপাঠির গাড়ির ড্রাইভার আমাদের একটা চটি বই দিয়েছিল; মুর্দা জিন্দা হবার মতো বই বটে ! বইটার নাম, 'শরীর নিয়ে খেলা' | মনে আছে, পাঠ্যবইয়ের নিচে রেখে লুকিয়ে লুকিয়ে বইটা পড়তাম | মোটামুটি কাছাকাছি সময়ে এ জাতীয় আরো কিছু চটি বই পড়ে নর-নারীর গোপন জীবন সম্পর্কে বেশ শক্ত-সোমত্ত একটা ধারণা অর্জন করে ফেলেছিলাম ওই অল্প বয়সেই | আর, মাঝে মাঝে স্কুল ফাঁকি দিয়ে রেলওয়ে কলোনির এক বাসায় কয়েকটা "ইয়ে" ফিল্ম দেখে অনেকটা বাস্তবজ্ঞানই অর্জন করেছিলাম বড়দের ওই গোপন জীবন সম্পর্কে | মোটামুটি এ উপায়েই তো আমরা দেশে ওসব জেনেছি, শিখেছি; কি বলেন বন্ধুরা ? ভেবে তাজ্জব লাগছে, ওসব একান্ত গোপন বিষয় এভাবে প্রকাশ্যে স্কুলে শেখানোর ব্যবস্থা ! এ কোন দেশে এলাম তাহলে? 

চিঠিটা পড়া শেষ করেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার স্ত্রীর দিকে বোবার মতো তাকিয়ে আছি | সাড়া নেই, শব্দ নেই | আমার স্ত্রী মুচকি হেসে আমার গালে চিমটি কেটে বলল, কী.., বেহুঁশ হয়ে গেলে নাকি গো ? 

তাড়াতাড়ি সম্মতি পত্রের 'না' কলামে স্বাক্ষর করে আমার স্ত্রীর হাতে চিঠিটা দিয়ে বললাম, এসব নোংরা দেশ আসলে আমাদের জন্য না, ভদ্রলোক থাকার পরিবেশ এখানে নেই, অনেক হয়েছে, অনেক হয়েছে, চলো, এবার দেশে চলে যাই | একটু থেমে আরো বললাম, আমার ভাগিনী পিংকি ভার্সিটিতে পড়ে, অথচ, এখনো ওসবের কিচ্ছু বুঝে না, দুলাভাই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে এ কথা বলেছিলেন, মনে নেই তোমার? মনে নেই? উনি আরো বলেছিলেন, ভাই, দোয়া করো যেন ওসবের দিকে কখনো মেয়ের মন না যায়, শুধু পড়ালেখা করে .. - তোমার সামনেই তো সব বলেছিলেন, মনে নেই?, মনে নেই তোমার? - আমি একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি বন্ধুরা; মাফ করবেন | - 'কিন্তু, তুমি কানাডা ফেরার মাস ছয়েকের মাঝেই তো সে ওই ছেলেটাকে বিয়ে করলো ..' গুনগুন করে আমার স্ত্রী বলল | মেয়েরা দেখি সুযোগ পেলে ছাড়ে না | কথাটা শুনেও না শোনার ভান করলাম |

চিঠির বিষয়টা আমি যতটা সিরিয়াসলি নিলাম স্ত্রীর নিরুদ্বিগ্ন মুখ দেখে মনে হলো ও সেভাবে নেয় নি | মনে হলো, সেও মনে হয় এদেশীদের সাথে মিলেমিশে এদের মতো খারাপ মনের হয়ে গেছে | মুখ খুলে ওকে কিছু না বললেও মনে মনে খুব হতাশ হলাম এ ভেবে, এই তথাকথিত উন্নতদেশে দেশে এসে মনে হয় স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সবই হারাতে বসেছি | এসব আ..র ভাল্লাগে না | কখন যে দেশে ফিরে যাবো?

চিঠিটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে আমার স্ত্রী বলল, 'তোমাকে আমার একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা বলি | ওটা শুনলে তুমি হয়তো মাইন্ড চেইঞ্জ করবে |' খাইছে ! ইনিও তো মনে হয় মিস পেটারসনের মতো আমাকে জ্ঞানদান শুরু করছেন |

আগেই বলেছি বন্ধুরা, আমার স্ত্রীও এখানে স্কুল টিচার | ও বলছে, 'গতবছর আমার ক্লাসের কিছু স্টুডেন্টকে ওদের পেরেন্টস ওই বিশেষ ক্লাসে অংশগ্রহন না করতে আমাকে চিঠি দিয়েছিলেন | তাই, ওইসব স্টুডেন্টদের ক্লাসরুম থেকে ডেকে নিয়ে আলাদা করে নিয়মানুযায়ী স্কুলের অফিসে (কমন রুমে) পাঠিয়ে দিলাম | ক্লাসের মাঝপথে দেখি, অফিসে পাঠিয়ে দেয়া বাচ্চাদের কয়েকজন আমার ক্লাসরুমের বাইরে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে ক্লাসে যে ভিডিও'টা দেখাচ্ছি সেটা দেখছে, এবং শোনার চেষ্টা করছে আমি কি বলছি | তারও কিছু পরে, ক্লাস শেষ হবার মিনিট পাঁচেক আগেই দেখি অফিসে পাঠিয়ে দেয়া সবকটা বাচ্চা ক্লাসে ফিরে এসে সহপাঠীদের কাছে গভীর আগ্রহভরে জানতে চাইছে, আমি কী কী বিষয়ে কথা বলেছি |'

- ওরা কী বললো ? - জানতে চাইলাম |

আর বলো না, ওরা তো টিনএজার ! বুঝনা, কী বলবে বন্ধুদের ? আমি যা যা বলেছি তার সাথে মনের মাধুরী মিশিয়ে কত কিছু যে যোগ করেছে .. দেখে হাসব না কাঁদবো | আর, ওদিকে পেরেন্ট মনে করে আছেন তাঁর বাচ্চা এখনো কিছুই জানে না, কিছুই বোঝে না, এক্কেবারে কচি শিশু এখনো | তারচেয়ে বরং বাচ্চাগুলো এসব বিষয় টিচারের মুখে শুনলে অন্তত কিছু ফ্যাক্ট জানতে পারতো |

তারমানে, তুমি বলছ, 'নো' কেটে দিয়ে 'ইয়েস' করে দিতাম? 

অফকোর্স !

বন্ধুরা, গ্রেড টুএলভ বা, দ্বাদশ শ্রেনীর পরীক্ষার ফলাফলটা কিন্তু বাংলাদেশের মতো এদেশেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ | ওই রেজাল্টই নির্ধারণ করে দেয় ভবিষ্যতে কে কোন লাইনে পড়ালেখা করবে, কি হবে | মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিংসহ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের যে কোনো বিষয়ে ভর্তি হতে হলে বেশ ভালো রেজাল্টই করতে হয় দ্বাদশ শ্রেণীতে | অন্যথায়, টেকনিক্যাল কলেজ বা, স্কুলে ভর্তি হয়ে কোনো কারিগরী বিষয় বা, বৃত্তিমূলক শর্ট কোর্সে ভর্তি হবার সুযোগ রয়েছে | তবে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তারপরের পড়ালেখা একান্তই ছাত্রের ইচ্ছে-অনিচ্ছার উপর | প্রায়্সব বাবামাই আঠার বছর পূর্তির পর তাঁদের সন্তান আর পড়াশোনা করছে কি করছে না, বা কিভাবে তাদের জীবন যাপন করছে সে বিষয়ে নজরদারি করা থেকে বিরত থাকেন | আঠার পূর্তির পর ছেলেমেয়েরাও নিজের আয়ে নিজের মত করে এডাল্ট জীবন শুরু করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে | 

আজকাল বাংলাদেশেও অবশ্য পাশ্চাত্য কালচারের অনুপ্রবেশ ঘটছে | কারণ, অনেক ছেলেমেয়েকেই দেখা যায় আঠার বছর বয়স পূর্তিতে মা বাবার আরোপিত বিধিনিষেধ না মেনে নিজের মত করে জীবনযাপন করতে | তবে পার্থক্যটা এখানে, বাংলাদেশে বাচ্চারা বাপের হোটেলে খেয়েপড়ে বেহায়ার মতো মা বাবার উপর খবরদারি করে, আর, উন্নত দেশে ওরা নিজেরাই নিজেদের টাকাপয়সা উপার্জন করে, মা বাবার কাছে হাত পাতে না | যেমন ধরুন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মেয়েটা তার টিউশন ফি বা, অন্যান্য খরচের অন্তত আশি ভাগই নিজে যোগাড় করে উইকেন্ডে কাজ করে | আমরা দিতে চাইলেও ও নিতে সংকোচবোধ করে | উন্নত দেশের কালচার এমনই |

এখানে যে সব ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় তারা কিন্তু পড়াশোনার ব্যাপারে ভালই সিরিয়াস | নিজের টাকায় নিজে পড়ে তো !আমাদের দেশের মত কয়েকটা ব্রড কোয়েশ্চেন, শর্ট কোয়েশ্চেন বা, পুরনো বছরের কিছু প্রশ্নপত্র ঘেটে তোতাপাখির মত কিছু উত্তর মুখস্থ করে ভালো রেজাল্ট করে ফেলবে সে ব্যবস্থা এখানে নেই | আমি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়, দু'দেশেই পড়াশোনা করে দেখেছি, কেবল মুখস্থবিদ্যায় এখানে কাজ হয় না | ছাত্রদেরকে ভালো নম্বর পেতে হলে বিষয়বস্তুর অনেক গভীরে যেতে হয় | আর বিশ্বমানের বা, ওয়ার্ল্ড রেন্কিং কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে তো আরো কঠিন অবস্থা | বাংলাদেশ থেকে খুব ভালো রেজাল্ট করা একাধিক স্টুডেন্টকে আমি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নাকানিচুবানি খেয়ে দূর প্রদেশের অখ্যাত কোনো ইউনিভার্সিটিতে পালিয়ে যেতে দেখেছি বন্ধুরা |

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পড়াশোনার কথা বলতে গিয়ে আমার মেজোবোনকে মনে পড়ল আরেকবার | বছর পাঁচেক আগে যখন দেশে গিয়েছিলাম তখন আমার মেজ আপা আমাকে প্রশ্ন করেছিল, তুই কানাডার কোন ইউনিভার্সিটি থেকে যেন মাস্টার্স করেছিস?

- ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টো | জানো তো, এটা কিন্তু বিশ্বের টপ ইউনিভার্সিটির লিস্টে বেশ উপরের দিকেই আছে |

তাই? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ও কিন্তু বাংলাদেশে ওয়ান অফ দা টপ ইউনিভার্সিটিজ | - উনি বাংলাদেশের একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির রিজিওনাল ডাইরেক্টর | তাঁর ইউনিভার্সিটির নাম এখানে আর না বলি |

রিয়েলি? - অবাক হয়ে জানতে চাইলাম |

হ্যা, সত্যি | আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক বড় বড় সরকারী আমলা ডিগ্রী নিয়েছেন, তারপর, কর্মক্ষেত্রে প্রমোশনও পেয়েছেন | এছাড়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সাহেবও আগে একটা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন | টপ না হয়ে কি হবে ?

আমার এই বোনটা কি সব উদ্ভট ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে তাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের টপ ইউনিভার্সিটির একটা ভেবে তৃপ্তির ঢেঁকুর গিলছে দেখে মনে মনে হাসলাম | তাও, তর্কে না জড়িয়ে বরং একটু রসিকতা করেই বললাম, তো, তোমাদের এই ইউনিভার্সিটির নাম ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি রেংকিং লিস্টে আসছে কবে?

ওই লিস্ট তো ইহুদিদের করা, ওখানে আমাদের ইউনিভার্সিটির নাম আসবে কেমনে আশা করো? - ঝটপট উত্তর আপার; প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইরেক্টর বলে কথা !
-------------------------------------------------------------------------------------------
এম এল গনি : কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশি প্রকৌশলী, কথা সাহিত্যিক, গবেষক ও ছোটগল্পকার।

No comments:

Post a Comment